অভিমত

গায়েবি মামলার অ–পূর্ব বিচার

আদালত পাড়ায় কি চলছে দেখছেন তো। সাত দিনের পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল ঘেঁটে নিশ্চয়ই সবার বোঝা হয়ে গেছে যে এ দেশে গায়েবি মামলার এক অ–পূর্ব বিচার চলছে।

দশ সপ্তাহে বিএনপির প্রায় ৫০০ লোক ‘দণ্ড লাভ’ করে ফেলেছেন। এত দ্রুত সব কাজ চলছে যে দণ্ডপ্রাপ্তরা জীবিত না মৃত, গুম না মুক্ত, ঘটনাস্থলে ছিলেন কি ছিলেন না, সেসব কোনো কিছুই বিবেচনায় আসছে না।

যেমন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বংশালে পুলিশের ওপর হামলা ও দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ৬২ নেতা-কর্মীকে ৪২ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ওই একই সময় বনানীর কামাল আতাতুর্ক রোডের প্রসাদ ট্রেড সেন্টারের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির নামে রাস্তায় যানবাহন ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণের দায়ে দণ্ড দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আলিম নকিসহ আরও ১০ জনকে। উদাহরণ আরও আছে।

প্রায় চার বছর আগে আবু তাহের দাইয়া নামে নিউমার্কেট থাকার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক মারা যান। গত সোমবার আদালত তাঁকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। শুধু তা-ই না, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছেন। দৈনিক সমকাল বলছে, তিনি ২০২০ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচন চলার সময় পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচতে এলাকা ছাড়েন। ওই বছরের ১৯ জানুয়ারি আশকোনা এলাকায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে আদালতের নির্দেশ তামিলকারী পুলিশ প্ল্যানচেট করে আবু তাহেরকে কারাগারে ঢোকাবেন না কবর খুঁড়ে তাঁর কঙ্কাল বের করবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আদালত দণ্ড দিয়েছেন গুমের শিকার দুই ব্যক্তিকেও। দণ্ডপ্রাপ্তদের একজন ঢাকা মহানগর ৩৮ (বর্তমান ২৫) নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন। তিনি ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। এই গুমের জন্য তাঁর পরিবার সরাসরি র্যাবকে দায়ী করে থাকে। এ নিয়ে তাঁরা উচ্চ আদালতেও গেছেন।

সাজেদুলের গুমের খবর জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ সদর দপ্তর, গোয়েন্দা সংস্থা, দেশি ও বিদেশি মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকেরা জানেন। কিন্তু আদালতের রায়ে তা প্রতিফলিত হয়নি।

গুম হয়েও আড়াই বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত অপর ব্যক্তি হলেন তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জাকির। তিনি ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে নিখোঁজ। ওই বছরের মে মাসে একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলায় আদালত তাঁকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেন।

আদালতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের পক্ষে যাঁরা মামলা লড়ছেন, তাঁরা মোটাদাগে বিচারপ্রক্রিয়ায় কমপক্ষে চার ধরনের ব্যত্যয়ের কথা বলেছেন। প্রথমত, এসব মামলার রায় হয়েছে মূলত পুলিশ সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত, ফৌজদারি মামলায় কাউকে দণ্ড দিতে হলে আদালতে অকাট্য তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে হয়। তাঁরা আলামত হাজির করতে পারেননি। তৃতীয়ত, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের জেলে পুরতে আদালত দিনে-রাতে বসে বিরতিহীনভাবে বিচার শেষ করেছেন। গোঁদের ওপর বিষফোড়া হিসেবে এই বিচারপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তরের একটি নির্দেশনা।

অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, এতে সমস্যাটা কী? প্রথম আলোয় প্রকাশিক এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর প্রতিবেদনটি পড়ে দেখতে পারেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে হামলার কথিত ঘটনাস্থলগুলোর মধ্যে ৩৪ টিতে গিয়েও প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা নাশকতার ঘটনা খুঁজে পাননি। কিন্তু এর ভিত্তিতে পরে ঢাকাজুড়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। ১০–১২ বছর আগে দায়ের হওয়া মামলার পাশাপাশি, পাঁচ বছর আগের এসব মামলাতেও বিচারকেরা এখন রায় দিচ্ছেন।

যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মামুন হাসানের আইনজীবী মো. জহিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে ২৩৭টি মামলা, যার ১৬৯টি মামলার বিচার চলছে। ছয়টি মামলার রায় হয়েছে। সবগুলোতেই সাক্ষী পুলিশ। কোনো কোনাটিতে মামলা যিনি দায়ের করেছেন, তিনিই তদন্ত করেছেন। এমন মামলা আরও আছে।

শুধু পুলিশ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রায় দেওয়ায় কোনো সমস্যা আছে কি না তা বিচার–বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। স্বতন্ত্র সাক্ষী না থাকায় ধর্ষণ, খুনের মামলাতেও অভিযুক্তদের খালাস দেওয়ার নজির আছে বাংলাদেশে।

স্বতন্ত্র সাক্ষী না থাকায় ধর্ষণ, খুনের মামলাতেও অভিযুক্তদের খালাস দেওয়ার নজির আছে বাংলাদেশে। আবদুল মান্নান বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় আপিল বিভাগ বলেন, স্বতন্ত্র সাক্ষীর সাক্ষ্য ছাড়া অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। মো. নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় আদালত খুনের দায়ে অভিযুক্তকে খালাস দেন। কারণ, আসামিপক্ষ যুক্তি দিয়েছিল যে বাদীপক্ষ শুধু নিজেদের পক্ষে সাক্ষী হাজির করেছে। স্বতন্ত্র সাক্ষী না থাকায় তাদের সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য হতে পারে না।

আবদুল মান্নান বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় আপিল বিভাগ বলেন, স্বতন্ত্র সাক্ষীর সাক্ষ্য ছাড়া অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। মো. নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় আদালত খুনের দায়ে অভিযুক্তকে খালাস দেন। কারণ, আসামিপক্ষ যুক্তি দিয়েছিল যে বাদীপক্ষ শুধু নিজেদের পক্ষে সাক্ষী হাজির করেছে। স্বতন্ত্র সাক্ষী না থাকায় তাদের সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য হতে পারে না।

আইনজীবীরা পুলিশ সদর দপ্তর গত ৫ সেপ্টেম্বরে জারি হওয়া এক নির্দেশনা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। ওই নির্দেশনায় আছে, পুলিশ সাক্ষীদের (বাদী) কোর্টে দেওয়া জবানবন্দি ও মামলার এজাহারে থাকা ঘটনার বিবরণে তারতম্য থাকলে সেসব চিহ্নিত করে ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রসিডিংস (ব্যবস্থা) শুরু করতে হবে।

কাজেই গায়েবি মামলার দায় থেকে কোনো পুলিশ সদস্য বাঁচতে চাইলেও পারবেন না। এটাও আইনের স্পষ্ট ব্যত্যয়। শপথ নিয়ে আদালতের কাছে মিথ্যা বললে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান আছে আইনে। অথচ এমন একটা নির্দেশনা থাকার পরও আদালত তা বিবেচনায় নেয়নি।

জাস্টিস ইজ ব্লাইন্ড বলে একটা কথা আছে। যার অর্থ বিচারালয় ন্যায়বিচারের স্বার্থে পক্ষপাতহীন হবেন। অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে বিচারকাজ পরিচালনা করবেন না।

ফ্রানজ কাফকার ট্রায়াল উপন্যাসে ৩১ বছর বয়সী ব্যাংকার জোসেফ কে এর জন্মদিনে তাঁর দরজায় টোকা পড়েছিল পুলিশের। তারা বলে, ‘আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। জোসেফ কে পাল্টা প্রশ্ন করেন, তো আমি কেন গ্রেপ্তার? পুলিশ বলে, আপনাকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেটা বলার অনুমতি নেই আমাদের। বিচারপ্রক্রিয়া চলছে, সবকিছু যথাসময়ে জানতে পারবেন। আমরাও জোসেফের সঙ্গে তাঁর অপরাধটা জানতে অপেক্ষা করতে থাকি উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু না জানতে পারেন জোসেফ, না আমরা।

বাংলাদেশের বেলায় অবশ্য ঘটনা একটু আলাদা। আমরা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না যে গায়েবি মামলাগুলোর এ ধরণের অ–পূর্ব বিচারের কারণটা কী।  

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক