‘যুক্তরাষ্ট্রে বসে বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া গেলেও পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে বাড়ির মেয়েকে প্রবাসী বরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগেই।’
‘যুক্তরাষ্ট্রে বসে বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া গেলেও পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে বাড়ির মেয়েকে প্রবাসী বরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগেই।’

যুক্তরাষ্ট্রে দুঃস্বপ্ন: বাংলাদেশিদের পারিবারিক নির্যাতন, কী প্রতিকার

নওরিন নাহার তুলি তাঁর ২১ বছরের জীবনকে অনেক রঙে রাঙিয়ে তুলেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে অল্প দিনের মধ্যে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় খুঁজে পাওয়ার দেরিও ছিল না বলা যায়। গর্ভে ছিল দুই মাসের সন্তান। তবু সুখী ছিলেন না নওরিন। স্বামীর হাতে পারিবারিক নির্যাতন সহ্য করেছেন অনেক দিন। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম বুঝে নিয়েছিলেন সুরক্ষা আদেশ। চেষ্টা করেছিলেন অনেক ভালো থাকার, বেঁচে থাকার। তবু ২০২৪ সালের নতুন সূর্য দেখা হয়নি তুলির।

২৪ ডিসেম্বর স্বামী নাসিব আহসান তুলিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের কলিন কাউন্টি জেলে রয়েছেন তিনি।

নওরিনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই বীভৎসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ১০ মিলিয়ন মানুষ পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। গড়ে প্রতি সপ্তাহে একজন নারী নিহত হন স্বামীর হাতে। বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিশেষ কোনো জরিপ করা না থাকলেও এশিয়ান এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দেখে বাংলাদেশিদের মধ্যে এ সমস্যার গভীরতার কথা আন্দাজ করা যায়।

সারভাইভারস অর্গানাইজেশনস অ্যান্ড অ্যালাইস রাইজিং (সাউথ এশিয়ান এসওএআর) হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় সংস্থাগুলোর জাতীয় মঞ্চ, তাদের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানায়, দক্ষিণ এশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ৪৮ শতাংশ মানুষ নানা ধরনের পারিবারিক নির্যাতন ভোগ করে থাকেন।

আবার মার্কিন মুসলিম পরিবারে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করা পিসফুল ফ্যামিলিজ প্রজেক্টের ২০১১ সালের এক জরিপে উঠে এসেছে, মার্কিন মুসলিম পরিবারের মধ্যে ৩১ শতাংশ মানুষ অন্তরঙ্গ সম্পর্কে পারিবারিক নির্যাতন অনুভব করেছেন। বলা বাহুল্য, এ সংখ্যা বাংলাদেশি গোষ্ঠীর বাস্তবতা থেকে দূরে নয়।

পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আমরা যারা কাজ করি, আমরা প্রত্যক্ষ করি যে তুলির মতো যে নারীরা একসময়ের আপনজনের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁরা দীর্ঘদিন বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার, নিগ্রহ সহ্য করেই বেঁচে থাকেন। পারিবারিক নির্যাতনের মূলে রয়েছে অসম সম্পর্ক, অধীনতা এবং জীবনসঙ্গীর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার মনোভাব। তাই জীবনের সব ক্ষেত্রে এই আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায় নির্যাতনকারী সঙ্গীটি। মানসিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক—বিভিন্ন রূপে দেখা যায় অসুস্থ সম্পর্কের প্রকাশ।

অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এই প্রকাশের তালিকায় যুক্ত হয় অন্যান্য ব্যবহারও। নতুন একজন অভিবাসী তাঁর অধিকার এবং সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণত ওয়াকিবহাল থাকেন না। এ সুযোগ নিয়ে তাঁর ওপর বিভিন্ন নির্যাতন হতে থাকে। অভিবাসনের নিয়ম না জানা থাকায় স্বামী তাঁকে ভয় দেখাতে পারেন দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার, তালাক দিয়ে দেওয়ার, এমনকি সংসারে কোনো সন্তান থাকলে তাকে মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি দেন।

এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নতুন দেশের ভাষা না জানা থাকার অসুবিধা। বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য এই সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। পিউ রিসার্চ সেন্টার তাদের ২০১৯ সালের এক জরিপে দেখতে পেয়েছে, যেখানে এশিয়ান জনগোষ্ঠীর ৭২ শতাংশ মানুষ ইংরেজি ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, বাংলাদেশিদের মধ্যে এই হার মাত্র ৫৫। বাংলাদেশি নারীরা ইংরেজি ভাষা না জানার কারণে অনেক সময় নির্যাতনের দুষ্টচক্র থেকে সহজে মুক্ত হতে পারেন না। নির্যাতনকারী এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁর জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বসে বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া গেলেও পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে বাড়ির মেয়েকে প্রবাসী বরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগেই। ঠিকমতো সব খবর নেওয়া হয়েছে কি না, অভিবাসনের কী পরিকল্পনা, মেয়ের পড়াশোনা ও কাজ করার বিষয়ে কোনো মতবিরোধ, আগের কোনো বিয়ে কিংবা পারিবারিক নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে কি না, অবশ্যই তা খতিয়ে দেখতে হবে।

বাংলাদেশ থেকে তুলির মতো নববিবাহিত নারীরা অনেক স্বপ্ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা করে দুঃস্বপ্নের জীবন যাপন করেন। তবে এর চেয়ে অসহায় অবস্থা হতে পারে, যদি প্রবাসী স্বামী বিয়ের পর গা ঢাকা দেন কিংবা স্ত্রীকে কোনো কারণ ছাড়াই পরিত্যাগ করেন।

এ ধরনের ঘটনা ভারতে সরকারিভাবে গণনা করা হয়। বাংলাদেশে এ বিষয়ে সচেতনতা এখনো গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী স্বামীর অপেক্ষায় থাকা নারীর সংখ্যা একেবারে কম হবে না। তাঁদের অনেকেই স্বামীর সঙ্গে অল্প সময় বসবাস করেছেন এবং পরে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন তাঁর পথ চেয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি নারীদের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথায় আমাদের কারও অবাক হওয়ার সুযোগ নেই। আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ২০৭ জন নারীকে তাঁদের স্বামীরা হত্যা করেছেন। জায়গা বদল হলেই যে মানসিকতার পরিবর্তন হবে, এর নিশ্চয়তা কী?

সে কারণেই নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই নারীবাদী সমাজ সংস্কারকদের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠে দক্ষিণ এশীয় নারীদের জন্য সাহায্যকারী সংস্থা। বাংলাদেশি নারীরা তাই বাংলা ভাষায় নিজেদের দুঃসময়ে যোগাযোগ করতে পারেন সাহায্যের জন্য। বিভিন্ন রাষ্ট্রের এই সংস্থাগুলো সবাই একটি মঞ্চে যোগাযোগ করতে পারে এবং বিভিন্ন সময়ে অভিবাসী নারীদের জন্য নানা প্রকল্প হাতে নেয়।

যুক্তরাষ্ট্রে বসে বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া গেলেও পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে বাড়ির মেয়েকে প্রবাসী বরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগেই। ঠিকমতো সব খবর নেওয়া হয়েছে কি না, অভিবাসনের কী পরিকল্পনা, মেয়ের পড়াশোনা ও কাজ করার বিষয়ে কোনো মতবিরোধ, আগের কোনো বিয়ে কিংবা পারিবারিক নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে কি না, অবশ্যই তা খতিয়ে দেখতে হবে।

বিয়ের আয়োজন ও সাজসজ্জা নিয়ে আমরা যে সময় ব্যয় করি, এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে জানতে হবে স্বামী ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে। বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ভিসার অধিকারী হয়ে থাকেন। জেনে নিতে হবে, এই ভিসা বিয়ের পর স্ত্রীর জন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে কি না।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা পড়াশোনা বা কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান, তাঁদের স্ত্রীরা বেশির ভাগ সময় আইনগতভাবে কাজ করতে পারেন না। তাঁদের পড়াশোনার খরচও হতে পারে অত্যন্ত বেশি। সবকিছু জেনে নিয়ে ভিনদেশে সংসার শুরু করলে সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা কম বলে আমাদের বিশ্বাস।

এত সাবধানতার পরও তুলির মতো জীবন ঝরে যেতে পারে। আইন করে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পরিবার ও সমাজের সবাইকে তাই এগিয়ে আসতে হবে নিঃসংকোচে। আমরা অনেক সময় দেখি, মেয়েরা পরিবারের চাপের কারণে নির্যাতন সহ্য করে সংসার চালিয়ে যেতে বাধ্য হন, অভিযোগ জানাতে পারেন না কর্তৃপক্ষের কাছে।

‘আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের মূল্য অপরিসীম। অতএব, পাছে লোকে কিছু বলে, এটা চিন্তা না করে নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। তাহলেই প্রবাসে নারী তার জীবন নতুন করে গড়ে তুলতে পারবে’—বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. নুসরাত আমিন, যিনি টেক্সাসে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত।

ডমিস্টিক ভায়োলেন্স সার্ভিসেস-ডায়া হাসটন (টেক্সাস), যেখানে ড. নুসরাত আমিন একজন জ্যেষ্ঠ পরিচালক এবং মৈত্রী (Maitri CA) যে সংস্থায় আমি জড়িত রয়েছি, আমাদের জন্য নির্যাতিত মানুষটি ছাড়াও পুরো সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রে পারিবারিক নির্যাতনবিষয়ক আইন রয়েছে, রয়েছে অসংখ্য সংস্থা, যারা বিনামূল্যে সেবা প্রদান করে। বছরজুড়ে আমরা প্রচার চালানোর পরও সমাজের ভয়ে অনেকে নির্যাতিত হয়েও সাহায্য নিতে সংকোচবোধ করেন। সমাজের সবার কাছে পৌঁছাতে তাই আমরা হাজির হই মসজিদে, মন্দিরে, নববর্ষের অনুষ্ঠানে শুধু পরিচিতির জন্য। সবাই মিলে প্রবাসে নির্যাতনমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব—সেই স্বপ্ন আমাদের প্রেরণা জোগায়।

  • জাকিয়া আফরিন মানবাধিকারকর্মী, আন্তর্জাতিক আইনবিষয়ক প্রভাষক এবং আইনের কথা ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা

তথ্যসূত্র ও সাহায্যকারী সংস্থার ঠিকানা
www.maitri.org
https://www.dayahouston.org/
https://www.southasiansoar.org/
https://www.peacefulfamilies.org/
https://www.pewresearch.org/