কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে দুই শতাধিক প্রাণহানির বিচার চেয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত
কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে দুই শতাধিক প্রাণহানির বিচার চেয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত

এত সব হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেন ছেলেভোলানো গল্প

শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন করছিল। একটা যৌক্তিক আন্দোলনকে সরকার যেভাবে দমন করতে চেয়েছে, কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এমন আচরণ সরকার করতে পারে কি না, এ নিয়ে যে কারও মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সে প্রশ্ন পুরো দেশের মানুষের মনে উঠেছে বলেই শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সব প্রান্তে। স্বাধীন বাংলাদেশ এমন প্রতিবাদ এর আগে কখনো দেখেছে কি না, ইতিহাসবিদেরা গবেষণা করে হয়তো বলতে পারবেন।

তবে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলা যেতে পারে, সরকার যেসব ভুল এর মধ্যে করেছে, সেগুলো যেন ইতিহাসের পাতায় সঠিকভাবে উঠে আসে। এর একটি তালিকা অন্তত থাকা প্রয়োজন। না হলে এই দেশে ইতিহাস বিকৃতির যে প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বিষয়কেও শাসকগোষ্ঠী নিজেদের মতো করে মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে দিতে পারে!

এই যেমন বাংলাদেশের মানুষ লাইভ ভিডিওতে দেখতে পেয়েছে, পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাঈদের মৃত্যু হয়েছে। যে মৃত্যুর কারণে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে। সেই সাঈদ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৬ বছরের এক কিশোরকে! এদিকে বাংলাদেশ পুলিশ বলছে, ‘আন্দোলনে মানুষের মৃত্যু সন্ত্রাসীদের গুলিতে হয়েছে!’ এর মানে হচ্ছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের করা জঘন্যতম অপরাধের দায় নিতে চাইছে না। এ থেকে আমরা কী বুঝতে পারি?

খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে, এমন অপরাধ সরকার করতেই থাকবে এবং অন্য কারও ওপর দায় চাপিয়ে দেবে। ইতিহাস নিজেদের মতো করে লেখার চেষ্টাও করবে। এ জন্য এই আন্দোলনে যা যা ঘটেছে, সরকার যা যা ভুল কিংবা অন্যায় করেছে, এর সঠিক তালিকা থাকা প্রয়োজন। তবে ভুল ও অন্যায়ের সংখ্যা এত বেশি যে তালিকাটা বোধ করি অনেক বড় হয়ে যাবে। এর মধ্যে কয়েকটা ভুলের কথা বরং তুলে ধরা যাক।

এক. শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। যেটা একটা যৌক্তিক দাবি ছিল। তাঁদের সঙ্গে প্রথমেই তো আলোচনা করা যেত। সরকার কেন আলোচনায় গেল না? যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকার হলে তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসত। জনগণের যৌক্তিক দাবিকে তোয়াক্কা না করার যে চর্চা আমরা এক যুগ ধরে দেখে আসছি, সেটার প্রতিফলনই আমরা দেখলাম।

দুই. আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ কিংবা ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পরবর্তী সময়ে অস্বীকার করেছেন যে তিনি শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলেননি। যদি ধরেও নিই, তিনি বলেননি, কিন্তু সরকারদলীয় সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা তো এখনো শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলেই যাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যে আন্দোলনকে দেশের বেশির ভাগ মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন, সেসব আন্দোলনরত শিক্ষার্থীকে রাজাকার হিসেবে উপস্থাপন করা মানে দেশের বেশির ভাগ মানুষকেই এক অর্থে রাজাকার বানিয়ে দেওয়া।

তিন. শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ–যুবলীগ বা হেলমেট বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া। নারী শিক্ষার্থীসহ অনেক ছাত্রছাত্রীকে তারা বেধড়ক পিটিয়েছে। সেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচকানাচে। অনেক জায়গায় তারা আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি চালিয়েছে। সবাই দেখতে পেয়েছেন যে কীভাবে একটা যৌক্তিক আন্দোলন সরকার নিজেদের পেটোয়া বাহিনীকে দিয়ে দমন করতে চাইছে।

চার. হেলমেট বাহিনী দিয়েও যখন আন্দোলন দমন করা যায়নি, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নামানো হয়েছে। এর আগে আমরা দেখতে পেয়েছি, কীভাবে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী সরাসরি গুলি করে ছাত্র–জনতাকে হত্যা করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিবৃতিতেও তা উঠে এসেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্যতম কাজ করার মাধ্যমে এ সরকারকে এখন ‘স্বৈরাচারী’ বলে অবহিত করা হচ্ছে। দেশের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে দেশের আপামর জনতাও এখন এই আন্দোলনে শামিল হয়েছে।

পাঁচ. আন্দোলন যখন সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সরকার যখন বুঝতে পেরেছে অবস্থা বেগতিক, তখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে, কারফিউ দিয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সরকার যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দিয়ে কত মানুষ হত্যা করেছে, এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে। কেন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো? কেন কারফিউ জারি করতে হলো? এ প্রশ্নও এখন সবাই করছেন। কত মানুষ মারা গেছে, এর সঠিক হিসাবই-বা কী? কিন্তু কোথাও কোনো সঠিক জবাব নেই।

ছয়. কারফিউ কিছুদিন চলার পর শুরু হয়েছে ধরপাকড়। যদিও সরকার বলছে শিক্ষার্থীরা জ্বালাও-পোড়াও করেননি, করেছে ‘তৃতীয় পক্ষ!’ অথচ দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাস্তা থেকে, বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঠিক পাকিস্তানি সেনাদের মতো করে। তরুণ ছেলেমেয়েরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের অভিভাবকেরা ভয়ের মধ্যে আছেন। কেন আপনারা তাঁদের ধরে নিয়ে যাচ্ছেন?

আন্দোলনের সমন্বয়কদের যেভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তা কোনোভাবেই নৈতিক ও আইনিভাবে সমর্থন করা যায় না। অথচ বলা হলো, তাঁদের নাকি নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছে! চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতাল থেকে তুলে নেওয়া কেমন নিরাপত্তা? সমন্বয়কারীরা নিজেরা তো এই নিরাপত্তা চাননি! এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সরকার এখন দেশের সবাইকে সন্দেহ করছে। তারা দেশের সব সাধারণ নাগরিককে সন্দেহের তালিকায় দেখছে। কেবল একটি স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষেই এভাবে দেশের বেশির ভাগ নাগরিককে সন্দেহ করা সম্ভব। কারণ, তারা জানে অনেকগুলো অপরাধ তারা এর মধ্যেই করে বসে আছে।

দেশের মানুষ এখন ক্ষমতাসীনদের স্বৈরাচারী সরকার বলছে। এত কিছুর পরও সরকার ভাবছে, সব দোষ অন্যদের। নিজেরা দোষ করে অন্যদের ঘাড়ে চাপানো শুরু করেছে। বিক্ষুব্ধ বর্তমান প্রজন্মকে কি এসব ‘ছেলেভোলানো গল্প’ দিয়ে মন গলানো সম্ভব?

  • আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: tutul_ruk@yahoo.com