২০১৮ সালের পর এই প্রথম শিক্ষার্থীরা রাজপথে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছেন। সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনে গত বুধবার পর্যন্ত কোথাও অঘটন ঘটেনি। তবে বৃহস্পতিবার যে সরকার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে, সেটা আগেই টের পাওয়া গিয়েছিল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খন্দকার মহিদ উদ্দিন গরমে–নরমে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় মেনে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি কেউ রাস্তা বন্ধ করে মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করলে পুলিশ প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে পারবে বলেও মন্তব্য করেন।
মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের প্রতি পুলিশের অবশ্যই ভালোবাসা, সহমর্মিতা আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, দেশের প্রচলিত আইন ও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে আমরা বাধ্য। সেই জায়গা থেকে ডিএমপির পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতি আমি বিনীত অনুরোধ করছি, তাঁরা যেন মানুষকে দুর্ভোগ দিয়ে কর্মসূচি না দেন।’ কিন্তু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা সরকারের এই ‘সদুপদেশ’ শোনেননি। ফলে কয়েকটি স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে গত রোববার ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি শুরু করেছেন তাঁরা। প্রথম দুই দিন রবি ও সোমবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন তাঁরা।
মঙ্গলবার গণসংযোগ কর্মসূচি পালনের পর বুধবার আবার সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাঁরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। তাঁদের এ কর্মসূচিতে সারা দেশ থেকে রাজধানী অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বৃহস্পতিবারও তাদের খণ্ডিত ব্লকেট পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে সেখানে আসেন শিক্ষার্থীরা। কয়েক শ শিক্ষার্থী সেখানে সমবেত হন। সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়।
কোনো ছাত্রসংগঠন রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ ডাকলে কয়েক শ লোক হয় না। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা সমাবেশ ডাকলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সমবেত হন। তাঁরা পুলিশের ব্যারিকেড অগ্রাহ্য করে মিছিল নিয়ে বাংলামোটর ও ফার্মগেট পর্যন্ত গেছেন। দেশের অনেক স্থানে সড়ক ও রেলপথ বন্ধ করে রেখেছেন। ন্যায্য দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন জনগণের সহানুভুতিও পাচ্ছেন। ২০১৮ সালের কোটা ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর এরকম ঘটনা আর ঘটেনি।
বুধবার পর্যন্ত রাজপথে ছাত্রলীগকে দেখা যায়নি। আর কোনো হাঙ্গামাও হয়নি। কিন্তু বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রলীগ মাঠে নামার ইঙ্গিত আমরা পেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইর থেকেও বিভিন্ন জায়গার ছাত্রলীগকর্মীদের ক্যাম্পাসে এনে জড়ো করা হয়।
পরবর্তীতে আমরা দেখলাম, পুলিশ মারমুখী অবস্থান নেওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিপেটা চালিয়েছে, কুমিল্লায় চালানো হয়েছে ফাঁকা গুলি।
এরপরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসেননি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের বাধার প্রতিবাদে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা–আরিচা মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন।
শিক্ষার্থীরা এখন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন, সেটা সঠিক। ২০১৮ সালেও সঠিক ছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন, আপিল বিভাগ কোটার বিষয়টি স্থিতাবস্থা ঘোষণা করার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কোনো যুক্তি নেই। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের যুক্তি হলো, আমরা তো কোটা পুরোপুরি বাতিল চাননি। সংস্কার চেয়েছি।
আগের একটি লেখায় ব্যাখ্যা করেছিলাম, সরকার নিজেই এ সমস্যা তৈরি করেছে। সেই সমস্যার কারণেই আজকে এসে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামতে বাধ্য হলো। কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে এলে নতুন করে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে হতো না। তাদের ভয়, আবার কেউ আদালতে গিয়ে আরেকটি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসতে পারেন। শিক্ষার্থীরা সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান। আর সেটা আসতে হবে নির্বাহী বিভাগ থেকেই। প্রয়োজন সরকার একটি কমিশনও গঠন করতে পারে।
সরকারের মন্ত্রীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যখন তৃতীয় পক্ষের নাকগলানোর আশঙ্কা করছেন, তখন বিএনপির নেতারা বিষয়টি দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তাদের দাবি, দুর্নীতি, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও নিত্য পণ্যের দাম আকাশচুম্বী বেড়ে যাওয়ায় সরকার বেকায়দায় আছে। এ জন্য তারা নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করেছে।
এখানে সাফ একটি কথা বলা প্রয়োজন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা সরকারি বা বিরোধী কেনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। তাঁদের আন্দোলন প্রমাণ করেছে, প্রচলিত ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতি (এমনকি রাজনৈতিক দল) সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন নেই।
কোনো ছাত্রসংগঠন রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ ডাকলে কয়েক শ লোক হয় না। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা সমাবেশ ডাকলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী সমবেত হন। তাঁরা পুলিশের ব্যারিকেড অগ্রাহ্য করে মিছিল নিয়ে বাংলামোটর ও ফার্মগেট পর্যন্ত গেছেন। দেশের অনেক স্থানে সড়ক ও রেলপথ বন্ধ করে রেখেছেন। ন্যায্য দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন জনগণের সহানুভুতিও পাচ্ছেন। ২০১৮ সালের কোটা ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর এরকম ঘটনা আর ঘটেনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের রাজপথ ছেড়ে দিয়ে শ্রেণিকক্ষে যেতে বলেছেন। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে গেলেই যে ক্লাস–পরীক্ষা হবে, তার নিশ্চয়তা কী।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একযোগে না হলেও প্রায় একই সময়ে আন্দোলন করছেন। যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম, সরকারের মন্ত্রী–নেতাদের সুবচনে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে গেলেন। কিন্তু শিক্ষক ও কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি প্রত্যাহার না হলে অচল বিশ্ববিদ্যিালয় তো সচল হবে না।
সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় প্রত্যাহারের দাবিতে ১ জুলাই থেকে ধর্মঘটে থাকা শিক্ষকেরা দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলনে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। এরই মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলো। তাঁদের দৃঢ় ধারণা, আমলারা ভুল বুঝিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে এটি করিয়েছেন। একবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বাস্তবে সে রকম কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে নিতে নানা কৌশল নিয়েছেন। অন্তত বুধবার পর্যন্ত তাদের খেপিয়ে তুলতে চাননি। বরং আপিল বিভাগ যাতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখে, সেই চেষ্টা চালিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র যাতে বহাল থাকে সেই চেষ্টা করেছেন। মন্ত্রীদেরও অনেকে শিক্ষার্থীদের প্রতি উপদেশমূলক বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন।
কিন্তু শিক্ষকদের বিষয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেই। প্রধানমন্ত্রী দূরে থাক, কোনো মন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে পারেননি তাঁরা। আন্দোলনকরী একজন শিক্ষক বিমর্ষ কণ্ঠে এই কলাম লেখককে বললেন, একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে একদিন ফোনে কথা বলার পর সরকারের পক্ষ থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। অর্থাৎ শিক্ষকদের আন্দোলনকে পাত্তাই দিচ্ছে না সরকার।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি