সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেসব গরম রাজনৈতিক খবর পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে, যা ভবিষ্যতে প্রযুক্তিভিত্তিক আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। ঘটনাটি হলো রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সেটেলমেন্ট ব্যাংক (বিআইএস) ঘোষণা করেছে, তারা প্রজেক্ট এমব্রিজ নামের একটি ডিজিটাল সম্পদ এবং অর্থ লেনদেনের উদ্যোগ থেকে সরে আসছে।
প্রজেক্ট এমব্রিজ ছিল এমন একটি প্রকল্প, যা বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রাকে সংযুক্ত করে বৈশ্বিক লেনদেন সহজ এবং কার্যকর করার উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছিল। এটি ছিল বিআইএসের একটি মূল উদ্যোগ, যার লক্ষ্য ছিল এমন একটি আন্তব্যাংক লেনদেন ব্যবস্থা তৈরি করা, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।
কাজানের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিআইএসের প্রধান আগুস্তিন কারস্তেনস অক্টোবরের শেষের দিকে বলেছিলেন, ‘আমরা এমন কোনো প্রকল্পকে সমর্থন করতে পারি না, যা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত।’ যেহেতু পশ্চিমা দেশগুলো চায় না নতুন আর্থিক ব্যবস্থা পশ্চিমা আইন ও নীতির বাইরে চলে যাক, সেহেতু এটি তাদের মধ্যে একটি বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনেক দিন ধরেই সতর্ক করে আসছে, কিছু দেশ নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে নিজেদের আর্থিক ব্যবস্থা গড়তে চেষ্টা করছে।
কাজানে ব্রিকস নেতারা তাঁদের নতুন আর্থিক ব্যবস্থা গড়ার কথা বলেছেন এবং ডলারের পাশাপাশি একটি ব্লকচেইনভিত্তিক মুদ্রা চালু করার পরিকল্পনা করছেন। এটি করা গেলে তা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তাদের বাণিজ্যকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। এই বাস্তবতায় পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের সামনে এখন একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে। সেটি হলো পশ্চিমা মূল্যবোধে বিশ্বাসী এক সীমান্তহীন ডিজিটাল অর্থনীতি কি সত্যিই ভবিষ্যতে ভালোভাবে পরিচালিত হবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সংগঠিত করবে?
৮০ বছর ধরে বেসরকারি নেতৃত্বাধীন এবং সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত পশ্চিমা অর্থনৈতিক মডেল স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ব্রিকস নেতাদের বিকল্প পথে হাঁটার চিন্তা পশ্চিমাদের স্বাভাবিকভাবেই চিন্তায় ফেলেছে।
বেসরকারি উদ্যোগেই পশ্চিমা নিয়মকানুন এবং মূল্যবোধ ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে ন্যাটোর সদস্যদেশের বাইরেও একটি আর্থিক বলয় তৈরি হয়েছে। তাদের মাধ্যমেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও অর্থ পাচারবিরোধী নীতিগুলো বৈশ্বিক ব্যাংকিং এবং বাণিজ্যের কাঠামোয় জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্যাংক এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ডলারকে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তে নিয়ে গেছে এবং ডলার মার্কিন ব্যবস্থার দূত হিসেবে কাজ করেছে।
এই ব্যবস্থা বছরের পর বছর ধরে অর্থ পাচারকারী, সন্ত্রাসবাদে মদদদানকারী, মাদক ব্যবসায়ী এবং অন্য অপরাধীদের দমন করেছে। আবার এই ব্যবস্থাই এসব অপরাধীকে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবনে বাধ্য করেছে।
তবে নিয়ন্ত্রণহীন ডিজিটাল মুদ্রা দ্রুত গ্রহণ করায় অপরাধমূলক কার্যকলাপের বাড়বাড়ন্ত হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ব্রিকস এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।
ব্রিকস দেশগুলো এমব্রিজ প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা কি না প্রচলিত ব্রেটন উডস ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারে। এখন পশ্চিমা নেতাদের এমব্রিজ বা নতুন বৈশ্বিক বাণিজ্য ও পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মগুলোর সম্ভাবনা থেকে সরে আসা উচিত হবে না। বরং এগুলো থেকে কৌশলগতভাবে তাদের লাভবান হওয়ার উপায় খুঁজে বের করা উচিত।
যেভাবে পুরোনো আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পশ্চিমা নীতির লক্ষ্যে সহায়ক ছিল, ঠিক সেভাবেই নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোও পশ্চিমা স্বার্থের সহায়ক হতে পারে। এমব্রিজ ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে, ব্লকচেইন প্রযুক্তি ইন্টারনেট গতিতে বিশ্ব অর্থনীতিকে সংযুক্ত করতে পারে। এখন মূল প্রশ্ন হলো, সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য কীভাবে নিশ্চিত করা যায়। সম্ভবত এর সমাধান বেশ সহজ।
ব্রিকসের ডিজিটাল মুদ্রা পরিকল্পনার মোকাবিলায় পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হলো বিদ্যমান আর্থিক ব্যবস্থা বজায় রেখে তার আধুনিকায়ন করা। বর্তমানে বৈশ্বিক মুদ্রা লেনদেনের প্রায় ৯০ শতাংশ ডলারভিত্তিক, কিন্তু এই ব্যবস্থাটি ধীরগতি, ব্যয়বহুল এবং কিছুটা দুর্বল। ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বোর্ড মনে করে, এই দুর্বলতাগুলো ঠিক না করলে এই ব্যবস্থা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
এ পরিস্থিতিতে, আমেরিকার জন্য কার্যকর সমাধান হতে পারে নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল ডলার গ্রহণ করা। এটি বর্তমান ফিয়াট মুদ্রা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করার পাশাপাশি ব্রিকস বা অন্য প্রতিযোগীদের ডিজিটাল মুদ্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে।
বিশেষ করে বেসরকারি খাতের দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক ডলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নতুন ডিজিটাল ডলার ব্যবস্থায় তাদের এই ভূমিকা অব্যাহত রাখা উচিত।
মোদ্দাকথা, নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল ডলার চালু করা, আমেরিকার অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখা এবং ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট সিস্টেমের ঘাটতি পূরণের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এটি ব্রিকসের নতুন ডিজিটাল মুদ্রা পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জকেও সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
পশ্চিমা দেশের নীতিনির্ধারকেরা কি ব্রিকস নেতাদের মতো ডিজিটাল মুদ্রার প্রতি উৎসাহ দেখাতে পারবেন এবং ডিজিটাল ডলার ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার পদক্ষেপ নিতে পারবেন?
যদি তাঁরা এগিয়ে আসতে চান, তবে তাঁদের প্রথম কাজ হবে ডলার স্টেবলকয়েনের (একধরনের ডিজিটাল মুদ্রা) জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করা। এই উদ্যোগ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে দুই পক্ষের সমর্থন পেয়েছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র একটি মান নির্ধারণ করে, যেখানে ডিজিটাল ডলারের নিরাপদ ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়, তবে এটি প্রমাণ করবে যে ডিজিটাল অর্থনীতিতে ডলার এখনো গুরুত্বপূর্ণ এবং আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম।
অন্যদিকে যদি তারা এমব্রিজ প্রকল্প বা টোকেনাইজেশনের মতো প্রযুক্তিগুলোর গুরুত্ব উপেক্ষা করে, তবে এটি তাদের জন্য একটি বড় কৌশলগত ক্ষতি হতে পারে। কারণ, বর্তমানে বৈশ্বিক লেনদেনে ডলারের আধিপত্য কমতে শুরু করেছে এবং এটি ‘একাধিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান’ হিসেবে স্থান নিচ্ছে।
● অ্যান্ড্রু গ্যালুচি মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও সিআইএর সাবেক অবৈধ অর্থায়ন ও ম্যাক্রোইকোনমিক বিশেষজ্ঞ
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ