মতামত

আমেরিকার ব্যর্থ কৌশল ইউক্রেনে যেভাবে বিপর্যয় ডেকে আনছে

যুদ্ধে নিহত এক ইউক্রেনীয় সেনার মা তাঁর সন্তানের সমাধির পাশে
ছবি : রয়টার্স

ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়াসহ মুসলিম–অধ্যুষিত দেশগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’-এর মতো সামরিক অভিযান সুসংহত কৌশল না থাকায় ব্যর্থ হয়েছে। পোলিশ সমরবিদ কার্ল ভন ক্লোজোউইটজ মনে করতেন, যুদ্ধ অন্যভাবে রাজনীতিরই সম্প্রসারিত রূপ। তাঁর কাছ থেকে ধার নিয়ে বলা যায়, যুদ্ধ ঐতিহ্যগতভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। আরও স্পষ্ট করে বললে, রাষ্ট্র অথবা অরাষ্ট্রীয় সংস্থার মধ্যে সহিংসতার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ফলাফল বের হয়ে আসে।

যা-ই হোক, যখন কোথাও সামরিক বাহিনী পাঠানো হয়, তখন এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিক নেতৃত্বই তাদের সেই নির্দেশ দেয়। এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী, সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে নির্ধারণ করতে হয়। মাঝপথে অবস্থান বদলানো যায় না। কিন্তু গত ৩০ বছরে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পর রাষ্ট্রনীতি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস এটিকে বলেছেন ‘মিশন ক্রিপ’। মাঝপথে গোলপোস্ট বদলের এই নীতি শেষ পর্যন্ত খেলায় জেতাটাকেই অসম্ভব করে তোলে।

১৯৪৫ সালের পর অনেক দেশে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় যে ব্যর্থতা, সেটিকে বিপর্যয়ই বলা যায়। এতে মার্কিন সেনাবাহিনীর সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে চীন, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়ার মতো সত্যিকারের বড় বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে বাধা দেওয়ার মতো সামরিক প্রস্তুতি ও সক্ষমতা তাদের কতটা আছে, সেই প্রশ্নও সামনে নিয়ে এসেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ওয়াশিংটনকে হয় একটা অলৌকিক ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, নাহয় রাশিয়া যত দিন না পর্যন্ত ইউক্রেনকে চুরমার করে ফেলছে, তত দিন অপেক্ষা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলগত অবস্থান এবং ন্যাটো জোটের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুর বিশ্ব ব্যবস্থার বদলে নতুন বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের ব্যর্থতা নামের কারখানার শোচনীয় পণ্যগুলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দিয়েছে। গত বছর রাশিয়ানরা ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে অবরুদ্ধ দেশটিকে সয়লাব করে দিয়েছে।

এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাটা কী? প্রাথমিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য দেখে মনে হয়েছে, ন্যাটোর মিত্রদের রাশিয়ার প্রতি বিমুখ করে তোলা। এটা অবশ্যই বিচক্ষণ কৌশল ছিল, সেটা কাজও করছিল। ইউক্রেনীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে ১ লাখ ৬০ হাজারের আগ্রাসনকারী রাশিয়ার বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

ওই সময় রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকিয়ে দিয়ে রাজধানী কিয়েভ ও প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। এরপরের যৌক্তিক পদক্ষেপটি হতে পারত শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ বের করা। এমন একটি মীমাংসায় পৌঁছানো, যাতে পশ্চিম ইউক্রেনকে পুরোপুরি মুক্ত করা যায় এবং পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষী অঞ্চল ও ক্রিমিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায়।

প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার পরই ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র তাদের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে ইউক্রেনীয়দের তারা উৎসাহিত করল, তাঁদের ভূখণ্ড রক্ষার বাস্তবসম্মত লক্ষ্য বদল করতে। জেলেনস্কি সরকার পূর্ব ইউরোপ এবং ক্রিমিয়া উপদ্বীপ থেকেও রাশিয়ানদের হটিয়ে দেওয়ার দাবি জানাল।

সম্প্রতি পশ্চিমা নেতারা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উৎখাত এবং রাশিয়ান ফেডারেশন ভেঙে টুকরা করে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করছেন। সব পরিস্থিতি যদি অনুকূলে থাকে এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য যদি একটি বিশ্বযুদ্ধ হয়, তারপরও এ আকাঙ্ক্ষা পূরণ অসম্ভব একটা বিষয়। কিন্তু ওয়াশিংটনে কল্পনাজগতে বসবাসকারী নীতিনির্ধারকেরা এই বিভ্রমের মধ্যেই নিজেদের ছুড়ে দিয়েছেন। আর অসম্ভব এক স্বপ্ন দেখিয়ে ইউক্রেনীয়দের কৌশলগত আত্মহত্যার পথে নিয়ে গেছেন।

কৌশলগত বিষয়ে মূর্খ আমেরিকানদের অন্ধের মতো অনুসরণ করে ইউক্রেনীয়রা নিজেদের নিঃশেষ করে দিচ্ছেন। একই সঙ্গে রাশিয়া যে বিশাল পাল্টা আঘাত করে চলেছে, তাতে ন্যাটোর দেশগুলোর কোষাগার ও অস্ত্রভান্ডার শূন্য হচ্ছে। আর ইউক্রেনে অবিকল এটাই ঘটে চলেছে।

ভূরাজনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউক্রেন প্ররোচনার ফাঁদে পা দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ রাশিয়ার বিরুদ্ধে এমন এক হঠকারী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, যেটা জেতা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর যুদ্ধ বড় পরিসরে ছড়ানোর যে প্ররোচনা পশ্চিমারা দিচ্ছে, তার জন্য নিজেরাও প্রস্তুত নয়। এই সংকটকালে ওয়াশিংটনে কি এমন কোনো তরুণ নেই, যিনি কিনা বলবেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটা পুরোপুরি এড়ানো যেত। হায়, ওয়াশিংটনের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের আত্মসক্ষমতা কতটা, সেটা নিজেরাই বুঝতে অক্ষম।

এই ‘অপদার্থ যুবরাজ’দের এখন উচিত তাঁদের ব্যর্থ কৌশলের যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ইউক্রেনীয় ও আমেরিকান তরুণদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। ওয়াশিংটনের শাসকশ্রেণি দশকের পর দশক ধরে কৌশলগত জায়গায় বোকার মতো পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একেকটা বিপর্যয় বিশ্ব ব্যবস্থায় শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান একটু একটু ধসিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের শুরু করা এই অন্তহীন যুদ্ধে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে খুব বেশি বিকল্প নেই।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ওয়াশিংটনকে হয় একটা অলৌকিক ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, নাহয় রাশিয়া যত দিন না পর্যন্ত ইউক্রেনকে চুরমার করে ফেলছে, তত দিন অপেক্ষা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলগত অবস্থান এবং ন্যাটো জোটের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক মেরুর বিশ্ব ব্যবস্থার বদলে নতুন বহু মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

  • ব্রান্ডন জে ওয়াইকার্ট, যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ