মতামত

‘পুলিশ জীবনের স্মৃতি’: জঙ্গি অভিযান ও সাগর–রুনি হত্যা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও বিতর্ক

গত বছরের মে মাসে সাবেক পুলিশপ্রধান এ কে এম শহীদুল হকের লেখা একটি বই প্রকাশ হয়েছে। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) থেকে বের হওয়া বইটির নাম পুলিশ জীবনের স্মৃতি: স্বৈরাচার পতন থেকে জঙ্গি দমন

পুলিশে কর্মরত অবস্থায় লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বইটি লেখা হয়েছে। যেহেতু লেখক একটি রাষ্ট্রীয় আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পদাধীকারী ছিলেন, তাই তাঁর বইয়ের বক্তব্যকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এ বইয়ে এমন কিছু বক্তব্য ও ঘটনার বর্ণনা রয়েছে যা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন উঠতে পারে, বিতর্ক তৈরি হতে পারে।

শহীদুল হক ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি অবসরে যান। পুলিশে তাঁর চাকরিজীবন ৩২ বছর হলেও এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়  হলো তিনি যখন পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন এবং অপারেশন) এবং আইজিপি ( (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এসব পদে থাকা অবস্থায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় এবং তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হয়। এ কারণে  সরকারের পছন্দের ব্যক্তিদের এসব পদে পদায়ন করা হয় বলে একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০০৯ সালের ১৬ মার্চ শহীদুল হক ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। এরপর ২০১০ সালের অক্টোবরে অতিরিক্ত আইজিপি এবং ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আইজিপি হন। তিনি যে সময় (২০০৯–২০১৮) গুরুত্বপূর্ণ এ পদগুলোতে ছিলেন, বাংলাদেশে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তাঁর বইটিতে এসব অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। কিন্তু এখানে সব বিষয় আলোচনা করার সুযোগ নেই। সাগর–রুনি হত্যাকান্ড, জঙ্গিবিরোধী অভিযান এবং ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে পুলিশ ও প্রশাসনের মনোভাব নিয়ে তিনি যেসব কথা বলেছেন, এ লেখায় সেরকম কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সাগর–রুনি হত্যাকান্ড ও ‘মনগড়া বক্তব্য’

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের একটি ভাড়া বাসায় খুন হন  সাংবাদিক দম্পতি সাগর–রুনি। এ হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। এ মামলার তদন্ত প্রতিবদেন জমা দেওয়ার তারিখ এখন পর্যন্ত ১০২ বার ( ২ বার ডিবি, ১০০ বার র‍্যাব) পেছানোর আবেদন করা হয়েছে এবং আদালত তা মঞ্জুরও করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত না হওযায় এ মামলার বিচার এখনও শুরুই হয়নি।

শহীদুল হকের বইয়ে সাগর–রুনি হত্যাকান্ড নিয়ে যে অংশটুকু রয়েছে সেটার শিরোনাম হলো ‘সাগর–রুনি: একটি আলোচিত হত্যাকান্ড’। এখানে তিনি লিখেছেন, ‘ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার মিডিয়াতে মনগড়া বক্তব্য দেন। কিন্তু বাস্তবতার সাথে তাঁদের কথার কোন মিল না পাওয়ায় সাংবাদিক মহলের মধ্যে ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় আমি ডিবির অফিসারদের নিয়ে তদন্তের অগ্রগতি আলোচনা করি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলার ডকেট পর্যালোচনা করি।

ডিবি পুলিশ অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়েই তদন্ত করছিল। তদন্তকারী ও তদারকি অফিসাররা বিভিন্ন ধারণা নিয়ে রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘটনার প্রায় দুই মাস পর ২০১২ সালের ১৮ই এপ্রিল হাইকোর্ট র‍্যাবকে মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন। এতেই আসলে তদন্তের গতি থেমে যায়। পুলিশের পেশাদার তদন্ত সংস্থা হলো সিআইডি ও ডিবি। তাদের কাছে তদন্তের ভার থাকলে ভালো হতো। কিন্তু এটা না করে মামলা র‍্যাবে যাওয়ার পর তদন্তের আর তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। বছরের পর বছর বার বার শুধু প্রতিবেদন দেওয়ার সময় পেছানো হয়েছে। মানুষের কাছেও বিষয়টা আজও অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক হয়ে আছে।’

শহীদুল হক তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারের বিরুদ্ধে মনগড়া বক্তব্য দেওয়ার যে ‘অভিযোগ’ তুলেছেন, সেটা নানারকম প্রশ্নের উদ্রেক করে। এসব প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে, তাঁরা কেন এবং কোন উদ্দেশ্য এমন ‘মনগড়া’ বক্তব্য দিলেন? এরকম দায়িত্বশীল পদে থেকে সত্যিই কি ‘মনগড়া’ বক্তব্য দেওয়া যায়? স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপি যদি এমন ‘মনগড়া’ বক্তব্য দেন, তাহলে পুলিশের প্রতি মানুষ কীভাবে আস্থা রাখবে? সাগর–রুনি হত্যা মামলাটি পুলিশের কাছ থেকে র‍্যাবে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় শহীদুল হক যেভাবে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন, তাতে র‍্যাবের তদন্ত–সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।

দেশে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা আগেও ছিল, এখনও আছে– এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী কিছু অভিযান নিয়ে জনমনে নানারকম প্রশ্ন রয়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে শহীদুল হক বইটিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটা সেসব পুরনো প্রশ্নগুলোকে নতুন করে সামনে নিয়ে এলো।

জঙ্গিবিরোধী অভিযান বনাম ‘নাটক’

শহীদুল হকের এ বইয়ে বেশ কিছু জঙ্গিবিরোধী অভিযানের বর্ণনা রয়েছে। এর মধ্যে একটির  ঘটনাস্থল হলো পান্থপথে স্কয়ার হাসাপাতালের উল্টোপাশে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনাল।

‘১৫ই আগস্ট ২০১৭ : জঙ্গি হামলার আশঙ্কা’ শিরোনামে বইয়ের এ অংশে বলা হয়, টেলিফোন ইন্টারসেপ্ট করে সিটিটিসি (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) জানতে পারে জঙ্গিদের ক্ষুদ্র একটি দল ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে ৩২ নম্বরে জমায়েত হওয়া মানুষের ওপর হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল। পুলিশের সোয়াত টিম একজন জঙ্গির অবস্থান শনাক্ত করে এবং ওই দিন ভোররাতে হোটেলের রুমটি ঘিরে ফেলে। পুলিশ দরজা ভাঙ্গতে শুরু করলে রুমের ভিতরে থাকা জঙ্গি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ‘আত্মাহুতি’ দেয়।

এ ঘটনার পরদিন শহীদুল হক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি এ বইয়ে সে সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...১৫ই আগস্ট ২০১৭ তারিখের অভিযানের পর দিন গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘‘এত কাছাকাছি জঙ্গি এনে অপারেশনের নাটক না করলেই পারতে।’’’ এ কথার জবাবে শহীদুল হক কী বলেছিলেন সে সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘যা হোক, একটু নীরব থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, ‘‘স্যার, আপনার পুলিশ নাটক করে না। অন্য বাহিনী করতে পারে।…’’’

দেশে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা আগেও ছিল, এখনও আছে– এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী কিছু অভিযান নিয়ে জনমনে নানারকম প্রশ্ন রয়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান নিয়ে শহীদুল হক বইটিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটা সেসব পুরনো প্রশ্নগুলোকে নতুন করে সামনে নিয়ে এলো।

দ্য পলিটিকস অব টেররিজম এন্ড কাউন্টার টেররিজম ইন বাংলাদেশ বইয়ে দেশি–বিদেশি একাধিক গবেষক দাবি করেছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন আমলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে জঙ্গীবাদ ইস্যুকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনাগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পুলিশ–প্রশাসনের মনোভাব

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের সময় শহীদুল হক ছিলেন অতিরিক্ত আইজিপি। ‘একতরফা’ এ নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মনোভাব কেমন ছিল এ বইয়ে তার কিছু বর্ণনা আছে।

তিনি লিখেছেন, ‘সরকারের শেষ সময়ে সুবিধাবাদী অনেক পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার সুর বদলে যেতে দেখলাম। যারা এতদিন আওয়ামী লীগ আদর্শের লোক বলে পরিচয় দিত তাঁরাও বলা শুরু করল যে, আমাদের দেশে কখনো পরপর দুইবার একই দল ক্ষমতায় আসেনি।…কাজেই আওয়ামী লীগ জোর করে নির্বাচন করলে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু লাভ কিছু হবে না। বিএনপির মতোই দশা হবে। সুশীল সমাজের কিছু লোক, এমনকী আওয়ামী লীগের দুর্বল চিত্তের কিছু লোক এ ধরনের কথা বলত।’

শেষ কথা

পুলিশ জীবনের স্মৃতি: স্বৈরাচার পতন থেকে জঙ্গি দমন  বইয়ে শহীদুল হক একাধিকবার বলেছেন, অনেকের কাছেই তিনি আওয়ামী লীগের ‘সমর্থক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে তিনি দাবি করেছেন, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁর কোন রাজনৈতিক পক্ষপাত ছিল না। তাঁর এ দাবি কতটা সত্য বা মিথ্যা বইটি পড়লে একজন পাঠক হয়তো কিছুটা ধারণা পাবেন।

তবে এ বই শুধুমাত্র একজন সাবেক পুলিশপ্রধানের স্মৃতিচারণাই নয়, এটা থেকে একটি বিশেষ কালপর্বে আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন–শৃ্ঙ্খলা বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন কর্মকান্ড ও ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়। আর এ কারণেই এ বইটি কিছু প্রশ্ন, কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক