উত্তর আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক গবেষণার কাজে বাংলাদেশে এসেছেন। যানজটের কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশ বিলম্ব হচ্ছিল। অগত্যা তিনি জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, আশপাশে পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ আছে কি না।
গাড়িটি যানজটে এমন জায়গায় তখন আটকে আছে যে এই শহরে বেড়ে ওঠা যে কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব যে, ওই এলাকার আশপাশে এ জাতীয় কোনো সুবিধা নেই। ভীষণ অপরাধবোধ গ্রাস করা সত্ত্বেও অবশেষে ভদ্রলোককে আরেকটু অপেক্ষা করতে বলতেই হলো। এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের নগরপিতাদেরকে পড়তে হয়নি কখনো, তা হলফ করে বলা যায়। সেকারণেই ব্যাথিতের বেদন বুঝতে তারা অক্ষম।
জিডিপিতে ধেই ধেই করে এগিয়ে যাওয়া, উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের প্রথম দশ দেশের মধ্যে চলে আসা, তাপমাত্রার প্রতিকূল দামী কাচের দরজা-জানালা লাগিয়ে চোখ ধাঁধানো বহুতল ভবন বানিয়ে আকাশ ঢেকে ফেলা কিংবা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে উড়াল দিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা হলেও পথেঘাটে টয়লেটের বড় সংকট আমার বাংলাদেশের।
আপনজনের ডাকে সাড়া দিতে দেরি হলেও ‘প্রকৃতির ডাকে’ সাড়া দিতে কখনো দেরি করা যায় না। যে ডাক শোনা যায় না, যায় কেবল অনুভব করা, সেই ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে অনেক সময় স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় আনার মতো ফুরসতও থাকে না করো কারো। থ্রি ইডিয়টস সিনেমায় লাদাখের মতো বিশুদ্ধ জায়গায় খোলা আকাশের নিচে ভবনের গায়ে মূত্র বিসর্জনের অপরাধে কী পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল বিসর্জনকারীকে, তা মনে করলে আমাদের হাসি পেলেও সেখান থেকে যে শিক্ষাটি নেওয়া যেতে পারত, তা আর নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের পথেঘাটে শৌচকর্মের অভূতপূর্ব নমুনাই এর উদাহরণ।
অবশ্য পথেঘাটে থুতু ফেলার মতো এই কাজটিও বাংলাদেশে আমাদের সহ্য করতে হয়। পথেঘাটে প্রাকৃতিক কাজ সারার মতোই আরেকটি কাজ হচ্ছে যত্রতত্র থুতু ফেলা। এ কাজটিরও একক কৃতিত্ব পুরুষের। যেখানে সেখানে এ কাজটি চট করে সেরে নেবার একটি দারুণ সুবিধা পুরুষের রয়েছে। তবে এটি কি কেবল সুবিধার জন্যই, নাকি সামাজিক কাঠামো কিছু সুযোগও তৈরি করে দেয় এ কাজের জন্য? সামাজিক কাঠামোর বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখা যাক।
বাংলাদেশের রাজধানী শহরের পৌনে দুই কোটি নগরবাসীর জন্য ১০৩খানা গণশৌচাগারের সংখ্যাটি অন্যান্য দেশের গণশৌচাগারের সংখ্যার সঙ্গে কেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১ লাখ মানুষের জন্য গণশৌচাগারের সংখ্যা আইসল্যান্ডে ৫৬টি, সুইজারল্যান্ডে ৪৬টি, নিউজিল্যান্ডে ৪৫টি, ফিনল্যান্ডে ৪১টি, অস্ট্রেলিয়া ও অস্ট্রিয়ায় ৩৭টি, নরওয়েতে ৩৩টি। উল্লেখ্য, এ দেশগুলোর প্রায় সবগুলোতেই শপিং মল, কফিশপ ইত্যাদি স্থানে শৌচাগারের ব্যবস্থা রয়েছে এবং তা ক্রেতার জন্য উন্মুক্ত, এবং সেগুলো ওপরের সংখ্যাগুলোয় অন্তর্ভুক্ত নয়।
বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে পুরুষদের অতি স্বাচ্ছন্দ্যে শৌচকর্ম সারার দৃশ্য একটি নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, যদিও এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ২০১৮ সালের স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী সারার অপরাধে সর্বোচ্চ ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত দণ্ড নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই আইনের কোনো বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। রাস্তায় শৌচকর্ম না সারার জন্য নগর কর্তৃপক্ষ পৌনে দুই কোটি নগরবাসীর জন্য ১০৩খানা গণশৌচাগার বানিয়ে দিয়েছেন যার বেশ কিছু থাকে তালাবদ্ধ।
২০২২ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকায় সেসব শৌচাগার ব্যবহারকারীর যে পরিসংখ্যান প্রকাশ হয়, তাতে দেখা যায়, ২০০ পুরুষ যদি গণশৌচাগার ব্যবহার করেন, তার বিপরীতে নারী ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচ থেকে সাতজন (পান্থপথের গণশৌচাগারের তত্ত্বাবধানকারীর তথ্য অনুযায়ী)। কিংবা যদি পুরুষ ব্যবহারকারী সংখ্যা হয় ৩০০ জন, তাহলে সেখানে নারী ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ জন (তেজগাঁও রেলগেটের গণশৌচাগারের তত্ত্বাবধানকারীর তথ্য অনুযায়ী)। এ থেকে যে প্রশ্নটি চলে আসে অবধারিতভাবে, তা হলো, নারী কি পাবলিক টয়লেট ব্যবহার না করার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত? উত্তর হলো , হ্যাঁ, এবং সেটি শরীরের বারোটা বাজলেও।
একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে, ছোটবেলা থেকেই মেয়েশিশুকে শেখানো হয়, ‘লজ্জা নারীর ভূষণ’ এবং শৌচকর্মের মতো ‘গোপনীয়’ কাজ কখনোই জনসম্মুখে করা উচিত নয়। করলে সমাজের চোখে ‘অশালীন’, ‘খারাপ’ হিসেবে প্রতিপন্ন হতে হবে। একইভাবে কিন্তু একটি ছেলে শিশুকে এহেন কাজ থেকে বিরত থাকতে সেভাবে শেখানো হয় না। ফলে খোলা আকাশের নিচে তার শৌচকর্মে পথচারীর লজ্জা লাগলেও ওই কাজে নিয়োজিত পুরুষের লজ্জা লাগে না। বরং এতে খানিকটা পৌরুষের পরিচয়ই যেন প্রকাশ পায়।
এই পৌরুষদীপ্ত আচরণটি কি কেবল বাংলাদেশের পুরুষের? উত্তর হলো, না। ২০২৩ সালের এপ্রিলে বিলেতি পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে তুলে ধরা হয়ে যুক্তরাজ্যে গণশৌচাগারের অভাবে কীভাবে লোকে পথেঘাটে মূত্র বিসর্জন করছে। ব্রিটিশ টয়লেট অ্যাসোসিয়েশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেমন্ড মার্টিনতো বলেই ফেললেন শৌচকর্ম এখন রাস্তাঘাটের সর্বত্র। বাংলাদেশের মতো তাদেরও এ বিষয়ে আইন রয়েছে এবং ২০০৩ সাল থেকে এই কাজটি তাদের দেশেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৮৪৮ সালের পরপরই তারা গণশৌচাগার বানানো শুরু করে পথেঘাটে শৌচকর্ম বন্ধ করার জন্য। অবশ্য নারীর জন্যও যে গণশৌচাগার দরকার, তা উপলব্ধি করতে পারে ১৮৮০ সালের দিকে।
দেখা যাক, বাংলাদেশের রাজধানী শহরের পৌনে দুই কোটি নগরবাসীর জন্য ১০৩খানা গণশৌচাগারের সংখ্যাটি অন্যান্য দেশের গণশৌচাগারের সংখ্যার সঙ্গে কেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১ লাখ মানুষের জন্য গণশৌচাগারের সংখ্যা আইসল্যান্ডে ৫৬টি, সুইজারল্যান্ডে ৪৬টি, নিউজিল্যান্ডে ৪৫টি, ফিনল্যান্ডে ৪১টি, অস্ট্রেলিয়া ও অস্ট্রিয়ায় ৩৭টি, নরওয়েতে ৩৩টি। উল্লেখ্য, এ দেশগুলোর প্রায় সবগুলোতেই শপিং মল, কফিশপ ইত্যাদি স্থানে শৌচাগারের ব্যবস্থা রয়েছে এবং তা ক্রেতার জন্য উন্মুক্ত, এবং সেগুলো ওপরের সংখ্যাগুলোয় অন্তর্ভুক্ত নয়।
আবার আসা যাক ঢাকার গণশৌচাগারের কথায়। যারা শহরের গণশৌচাগার ব্যবহার করেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য কোনো ব্যবস্থা সেখানে নেই। টিস্যু এবং সাবান না থাকাকেও ব্যবহারকারীরা নিয়েছেন স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে। সেই সঙ্গে দরজা-জানালা, বা কমোডের সিট ভাঙা থাকা বা পানি না থাকাও পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক ব্যাপারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবের কথা বলা বাহুল্য। বিষয়টি অনেকটা এরকম, টয়লেট দরকার, টয়লেট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটি ব্যবহারোপযোগী কিনা, সেটা দেখার প্রয়োজন নেই।
৫৩ বছর বয়স্ক বাংলাদেশের খোদ রাজধানীর কর্তারাই যদি এ রকম একটি দরকারি বিষয়ের গুরুত্ব না বোঝেন, ট্রাফিক পুলিশ অথবা পথে ফেরি করে রোজগার করা মানুষগুলো কিংবা নিম্ন আয়ের/ প্রান্তিক মানুষদের তাহলে শৌচাগারের বদলে পথের ধারেই কাজ সেরে নিতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না?
নগরকে নান্দনিক করার জন্য কোটি টাকা ব্যয়ে বৃক্ষ উৎপাটন করে রাস্তার মাঝখানে ইস্পাত, লোহা, সিমেন্ট দিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করার চেয়ে ব্যবহারোপযোগী পাবলিক টয়লেট বেশি প্রয়োজন। ইজারা দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে না ভেবে টয়লেটগুলো ব্যবহার করার অবস্থায় রাখা হয়েছে কি না, তা তদারকি বেশি প্রয়োজন। নগরবাসী যে ট্যাক্স প্রদান করে, তাতে পাবলিক টয়লেটের সুবিধা তার পাওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইটে ‘মৌলিক কার্যাবলির’ তালিকায় পাবলিক টয়লেট সেবা নগরবাসীকে দেওয়ার কথা অন্তর্ভুক্ত নেই। তাহলে নগরবাসীর জন্য এই সেবা প্রদানের দায়িত্ব কার?
দায়িত্বটি কারো না কারো তো বটেই। সেই দায়িত্বশীলরা যদি মাসে অন্তত একদিন বিনা নোটিশে একটি করে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতেন, পাবলিক টয়লেট কী হওয়া উচিত আর কী হয়ে আছে, সে বিষয়ে কিঞ্চিৎ বোধোদয় হতো, তাতে সন্দেহ নেই। সেই বোধের উদয়ে পাবলিক টয়লেটের অবস্থা একটু ভালো হলেও হতে পারত।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইপ্সিতা কাজুড়ী ফ্রিলান্স গবেষক