চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ যে জিতবেন, এ কথা সবাই জানত। তিনি জিতেছেনও। কিন্তু কিছু জয় এমনই, যা বিজয়ী দলকে তৃপ্তি তো দূরে থাক, স্বস্তিও দিতে পারে না।
যদিও চট্টগ্রাম নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা এক বিবৃতিতে দলের নেতা-কর্মীসহ স্থানীয় ভোটারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং এই বিজয় বর্তমান সরকারের প্রতি মানুষের আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু মাত্র ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি যে প্রকারান্তরে একটি প্রত্যাখ্যানের বার্তা, এটা তাঁদের না বোঝার কথা নয়।
তিন বছরের মধ্যেই এই আসনে উপনির্বাচন হয়েছে দুবার। জাসদ নেতা ও সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুর পর ২০২০ সালে একটি উপনির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতা মোছলেম উদ্দিন আহমদও সংসদ সদস্য হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করলে আরেকটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো।
একসময়ের জমজমাট ভোটযুদ্ধের স্মৃতি ভুলে গিয়ে এই নির্বাচনের তুলনামূলকভাবে হিসাব-নিকাশও আওয়ামী লীগের জন্য যথেষ্ট হতাশাজনক। ২০টি ভোটকেন্দ্র ও ৪৪ হাজার ভোটার বাড়লেও প্রদত্ত ভোট কমেছে ৮ শতাংশ। তার চেয়েও বড় কথা, ২০২০ সালে বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন ভোট পেয়েছিলেন ৮৭ হাজার ২৪৬, যা মোট ভোটের ১৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
২০২৩ সালে এসে একই দলের জয়ী প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ পেয়েছেন ৬৭ হাজার ২০৫ ভোট, যা মোট ভোটের প্রায় ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তার মানে, নৌকার বাক্সেও ভোট কমে গেছে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ফলে নেতা-কর্মী বা ভোটারদের যতই মুখ রক্ষার অভিনন্দন জানানো হোক, এই নিম্নগামী পরিসংখ্যান চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতারা, এমনকি দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের জন্যও অস্বস্তির কাঁটা হয়েই থাকল।
উপনির্বাচনে ভোটদানের গোপন কক্ষটি যে যথেষ্ট গোপন ছিল না, সেটা তো আমরা সংবাদপত্রসূত্রে জেনেছি। এমনকি ভোটদানের কক্ষে একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতির ছবিও ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘তদন্ত চলছে’। এই তদন্তের ফলাফল কখন জানা যাবে বা আদৌ জানা যাবে কি না, তার উত্তর পাওয়া দুরূহ।
আশাভঙ্গের কিছুটা স্বীকারোক্তি আছে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের কথায়। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল ভোটার উপস্থিতি আরও ভালো হবে।’ পাশাপাশি কিছুটা সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি, ‘ঈদের লম্বা ছুটি ও শহর অংশের ভোটার নির্দিষ্ট ঠিকানায় না থাকায় এমনটি হয়েছে।...ভোটকেন্দ্রের দূরত্বের কারণেও অনেক ভোটার যাননি।’ এ ছাড়া প্রচণ্ড দাবদাহ, দলীয় নেতা-কর্মীদের একাগ্রতার অভাব, প্রবাসী ভোটারদের অনুপস্থিতি ইত্যাদি সমস্যার কথাও বলতে চেয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। কিন্তু এসব সমস্যাকে যতটা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো করা যায়, যুক্তি হিসেবে ততটা নয়। বরং এ উপনির্বাচনের প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ জেনে-বুঝেই হোক বা অনবধানতাবশতই হোক, যে কথা বলেছেন, তাতেই মূল কারণটা নিহিত বলে মনে হয়েছে আমাদের।
পত্রিকান্তরে নোমান বলেছেন, ‘গত উপনির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল। এবার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় দলীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যাননি। নৌকার প্রার্থী জিতে যাবেন—এ মনোভাবের কারণে আমার অনেক আপনজনও ভোট দিতে যাননি।’ অর্থাৎ প্রকারান্তরে স্বীকার করা হলো, বিএনপি না এলে ভোটের লড়াই জমে না। ভোটাররা যদি বুঝতেই পারেন যে তাঁর ভোটটি প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হবে না, তাহলে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর নির্বাচন বর্জন ভোটারের মনস্তত্ত্বে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এই উপনির্বাচন তার একটি দৃষ্টান্ত হিসেবেই বিবেচিত হবে।
ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী জয়ের প্রায় শতভাগ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ উপনির্বাচন কি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল? নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ইসলামী ফ্রন্ট ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থীরা পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছেন।
বোয়ালখালী-চান্দগাঁও আসনের উপনির্বাচনে ভোটদানের গোপন কক্ষটি যে যথেষ্ট গোপন ছিল না, সেটা তো আমরা সংবাদপত্রসূত্রে জেনেছি। এমনকি ভোটদানের কক্ষে একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতির ছবিও ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘তদন্ত চলছে’। এই তদন্তের ফলাফল কখন জানা যাবে বা আদৌ জানা যাবে কি না, তার উত্তর পাওয়া দুরূহ।
এ উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার আরেকটি কারণ হলো কালুরঘাট সেতু নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ও হতাশা। প্রায় ১০০ বছর পুরোনো একমুখী সেতুটি চট্টগ্রাম নগর ও বোয়ালখালীর মধ্যে যোগাযোগের সূত্র। উন্নয়নের এই ডামাডোলের মধ্যেও সেতুটিকে সংস্কার-মেরামত করে কোনোমতে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
এলাকাবাসীর ভোগান্তি নিরসনের জন্য নতুন সেতুর দাবি নিয়ে এলাকার সংসদ সদস্য মঈন উদ্দীন খান বাদল বারবার সংসদে সরব হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, প্রতিশ্রুতিও আদায় করেছেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় সেতু নির্মাণের ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখে যেতে পারেননি তিনি।
এরপর মোছলেম উদ্দিন প্রার্থী হয়ে যথারীতি সেতুটি নির্মাণের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিলেন। এলাকাবাসীর ধারণা ছিল, আগের সংসদ সদস্য অন্য দলের ছিলেন বলে সেতু নির্মাণের ব্যাপারে অগ্রগতি হয়নি। হয়তো আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হলে সরকার এটিকে অগ্রাধিকার দেবে।
কিন্তু মোছলেম উদ্দীনের সময়েও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ-আয়োজন না দেখে নিত্যবিড়ম্বনার শিকার এলাকাবাসী আশাহত হয়েছেন। ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’—এমন অনেক উন্নয়নের ভিড়ে কালুরঘাট সেতুর প্রতি এমন অবজ্ঞা-উপেক্ষার কারণেও এখানকার সাধারণ ভোটাররা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়েছেন বলে অনেকের ধারণা।
সব মিলিয়ে উপনির্বাচনটা মোটেই জমল না।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক