আগের নিবন্ধে (আধুনিক ভারতের ক্ষমাহীন ইতিহাস, প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর) অশোকা মোদির লেখা বই ইন্ডিয়া ইজ ব্রোকেন পর্যালোচনা করতে গিয়ে কংগ্রেস শাসনকালের বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন তুলে ধরেছি। আজকের নিবন্ধে বিজেপি শাসন, বিশেষত নরেন্দ্র মোদির শাসনকাল সম্পর্কে অশোকার মূল্যায়ন তুলে ধরব।
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই কংগ্রেসের সমাজতন্ত্রের বুলি, বৃহৎ শিল্প ও পরিকল্পনানির্ভরতা, ব্যর্থ ভূমি সংস্কার প্রচেষ্টা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নগর উন্নয়ন ও বেকারত্ব নিরসন ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে উপর্যুপরি ব্যর্থতার কারণে ভারতের জনগণ বিকল্প খুঁজতে থাকে।
আগেই বলেছি, রাজীব গান্ধীর মেয়াদকাল থেকেই হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটে, যা পরে আরও বেগবান হয়। এ সময় মৃদু হিন্দুত্ববাদের প্রতীক হয়ে দুবার ক্ষমতায় আসীন হন বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী। বাজপেয়ীর নেতৃত্বের প্রশংসা করে অশোকা বলেছেন, বাজপেয়ী তাঁর পূর্বসূরি নরসিমা রাও সূচিত অর্থনীতির উদারীকরণের ধারা অব্যাহত রাখেন। তিনি ভারতীয় মাপকাঠিতে স্থানীয় প্রতিযোগিতা, বেসরকারীকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। ফলে ১৯৯০-৯১ সালের শ্লথ জিডিপি প্রবৃদ্ধি কাটিয়ে ৮ শতাংশে উন্নীত হয়।
এতত্সত্ত্বেও দুই ভারত—নাদুসনুদুস ও বঞ্চিত ভারত পাশাপাশি একসঙ্গে অবস্থান করতে থাকে। অশোকা, ১৯৯৮ সালে রাম গোপাল ভার্মা নির্মিত সত্য ছায়াছবির উল্লেখ করে বলেন, একদিকে চরম বেকারত্ব ও সামাজিক সহিংসতা, অন্যদিকে অভিজাত শ্রেণির উন্নয়নের উপাখ্যান সমান্তরালভাবে চলতে থাকে।
অশোকা একই প্রসঙ্গে ১৯৫৫ সালের রাজকাপুর অভিনীত শ্রী ৪২০ ছবির সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, চার দশক পরে ভারতীয় বেকারত্বের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। অশোকা তাঁর বইয়ে তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি সমকালীন সাহিত্য, ছায়াছবিতে চিত্রিত সমাজজীবনের উদাহরণ দিয়ে বইটিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
একদিকে বস্তিবাসী ভারতীয়রা উচ্ছেদের আশঙ্কায় থাকে, অন্যদিকে মুকেশ আম্বানির ২৭ তলা প্রাসাদ নির্মিত হয়। নিঃস্ব কৃষকের আত্মহননের পাশাপাশি বিজয় মালিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণখেলাপি হয়ে লন্ডনে তাঁর আবাসস্থল থেকে ভারতে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চলতে থাকে। উন্নয়ন প্রকল্পের সুবিধা নিম্নগামী (ট্রিকল ডাউন) না হয়ে ঊর্ধ্বগামী (ট্রিকল আপ) হতে থাকে।
ফলে ২০০৪ সালে পুনরায় কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসে। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে মনমোহন সিং ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণে নেতৃত্ব দেন।
এ সময় মৃদু ও চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদের দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। প্রথমেই বাজপেয়ীর মৃদু হিন্দুত্ববাদকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যান চরমপন্থী বিজেপি প্রেসিডেন্ট এল কে আদভানি। তিনি রাম জন্মভূমি আন্দোলন ও অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণে নেতৃত্ব দেন এবং অযোধ্যা একটি নির্বাচনী ইস্যু হয়ে ওঠে।
২০০২ সালে গুজরাটের মুসলিম-অধ্যুষিত শহর গোধরায় একটি ট্রেনের বগিতে আগুন লাগার ঘটনায় ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী মারা যান। উগ্র হিন্দুরা এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারা গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধায়, প্রায় দুই হাজার মুসলমান এই ঘটনায় প্রাণ হারায়, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং নারীরা ধর্ষণের শিকার হন।
এ জন্য গুজরাটের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দায়ী করা হয়। মোদিকে বরখাস্ত করার দাবি উঠলে বাজপেয়ী তা প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে নতুন নির্বাচন করতে বলেন। মোদি উগ্র হিন্দুদের সহায়তায় ভূমিধস বিজয় লাভ করেন। এভাবেই মোদি চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠেন। গুজরাটের উন্নয়ন মডেল (যাঁকে অশোকা উপাত্ত দিয়ে ব্যর্থ বলেছেন) ও আদানি ও আম্বানির মতো ধনকুবেরদের ওপর ভর করে অবশেষে ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি।
অশোকা তাঁর বইয়ে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মোদির মুদ্রা রহিতকরণ (ডিমনিটাইজেশন), ভ্যাট প্রবর্তন, করোনাকালে লকডাউন ও আদানির মতো ধনকুবেরদের সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে তোলার ফলে সৃষ্ট ভারতীয় জনগণের দুর্ভোগের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
এসব ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মোদি সরকার করোনার বিস্তারের জন্য মুসলমানদের দায়ী করে। তারা আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ কোটির পরিবর্তে ১ কোটি এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৯ লাখের পরিবর্তে দেড় লাখ বলে প্রচার করে। সরকার শুধু করোনা নয়, অর্থনৈতিক উপাত্ত প্রচারের ক্ষেত্রে তথ্য ধামাচাপা দেয় ও ধূম্রজাল সৃষ্টি করে।
হিন্দুত্ববাদী বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদেরা এ ক্ষেত্রে ‘চিয়ার লিডারের’ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতী। সমালোচকদের নাকচ করে তিনি বলেন, ‘ভারত প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। চীন নয়, ভারতেই মোদির নেতৃত্বে অলৌকিক উন্নয়ন ঘটতে চলেছে।’
সার্বিকভাবে অশোকা সুইডেনভিত্তিক একাডেমিক থিঙ্কট্যাংক ‘ভি-ডেম’-কে উদ্ধৃত করে মোদির শাসনকে ‘নির্বাচিত স্বৈরাচার’ বলে উল্লেখ করেছেন।
কেন এমন হলো, অশোকা তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ১৯৮৪-৮৫ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত জিডিপির খাতওয়ারি প্রবৃদ্ধির উপাত্ত বিশ্লেষণ করে। সেখান থেকে দেখা যায়, অন্যান্য খাতের তুলনায় ব্যাংকিং ও নির্মাণ খাতের প্রবৃদ্ধি উদ্ভূত বুদ্বুদের কারণ, যা সাময়িক প্রবৃদ্ধির কারণ হলেও সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে পারেনি। বরং বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং, নির্মাণ খাত ও মাফিয়ার যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে, ভারতেও তার প্রসার ঘটে।
আরেক অর্থনীতিবিদ পার্থ দাশগুপ্তের গেম থিওরির কাজ উল্লেখ করে ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নের ব্যাখ্যায় অশোকা বলেছেন, সমাজ হচ্ছে রাজনীতির আয়না। যখন নৈতিক আদর্শ ভেঙে পড়ে, তখন সবাই ধরেই নেয়, অন্যরা প্রতারণা করবে; তখন সবাই প্রতারণা করে এগিয়ে যেতে চায়। এ ধরনের ‘আমি-আমি-আমি’ ভারসাম্যে (ইকুলিব্রিয়াম) নাগরিকদের পক্ষে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি, লুটপাট, নদী ভরাট, ঋণখেলাপি, মুদ্রা পাচার, নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি ইত্যাদি কার্যক্রমে লিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে ওঠে।
রাজনীতিবিদদের, অর্থনৈতিক নীতির ব্যর্থতা ও সাফল্যের বর্ণনার পাশাপাশি বইটিতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের মানবিক কাহিনি, নিপীড়নের মুখে সাংবাদিকদের ও ক্ষেত্রবিশেষে বিচারকদের সাহসিকতা, ভারতের জনগণের উদ্যম ও পরিশ্রমের বর্ণনা আছে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, লেখক অশোকা কী চান? অশোকার চাওয়া খুব সামান্য। তিনি চান, জন্মভূমির রাজনীতি ও অর্থনীতি ‘আমি-আমি-আমি’ ভারসাম্য থেকে ‘আমরা-আমরা-আমরা’ ভারসাম্যে ফিরে ভারত এগিয়ে যাক।
লেখার শেষ দিকে এসে অশোকার বইয়ের একটি সীমাবদ্ধতার কথা বলতেই হয়। তা হলো, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। বিশেষত ভারতের দ্বাদশ প্রধানমন্ত্রী গুজরালের ডকট্রিন সম্পর্কে আলোচনা আশা করেছিলাম। সেটা নেই।
এক. বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে প্রতিদান না চেয়ে ভারত যথাসম্ভব প্রতিবেশী দেশ যা চাইবে তা দেবে ও মেনে নেবে।
দুই. দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের ভূমি একে অন্যের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে দেবে না।
তিন. একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
চার. একে অন্য দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।
পাঁচ. পারস্পরিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে।
স্পষ্টতই ভারত এসব নীতি থেকে সরে এসেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অসম অর্থনৈতিক সম্পর্ক, গত তিনটি নির্বাচন, বিশেষ করে সর্বশেষ নির্বাচনই এর প্রমাণ।
পরিশেষে বইটি সম্পর্কে শশী থারুরের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলা যায়, অশোকার বইয়ের সব বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও উপসংহারের সঙ্গে সব পাঠক একমত হবেন তা নয়, আমিও নই। তবে এতত্সত্ত্বেও বলা যায়, অশোকা একটি অতিপ্রয়োজনীয় বই লিখেছেন। কেবল ভারতবর্ষের পাঠক নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁরা এই বই পড়ে উপকৃত হবেন।
● মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব