বিশেষ সাক্ষাৎকার: হাসনাত কাইয়ূম

সংবিধান শাসনতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫০ বছর পূরণ হতে যাচ্ছে ৪ নভেম্বর। বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধান সংস্কারের দাবির কথা জানানো হচ্ছে। সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। তার কতটা জনগণের স্বার্থে আর কতটা শাসকদের স্বার্থে, সেই প্রশ্নও উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে সংবিধানের নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন সুপ্রিম কোর্টের অাইনজীবী ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম

হাসনাত কাইয়ূম
হাসনাত কাইয়ূম
প্রশ্ন

৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। বিভিন্ন সময় সংবিধান সংস্কারের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। মূল সমস্যা সংবিধান, না সংবিধান যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা?

হাসনাত কাইয়ূম: সমস্যা দুটোতেই। মূল সমস্যা অবশ্যই সংবিধান। বাকিটা এর উপজাত। সংবিধান সংস্কারের যে দাবি এখন উঠেছে, সে দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়।

প্রশ্ন

আমাদের সংবিধানের প্রধান দুর্বলতা কোথায়? অনেকেই বলেন, সংবিধান রচনার সময়ই পদ্ধতির চেয়ে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। আইনজীবী হিসেবে আপনি কী বলবেন?

হাসনাত কাইয়ূম: আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীনদের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা না থাকা। সংবিধান অনুযায়ীই রাষ্ট্র, সরকার এবং সরকারি দল—সবকিছু একাকার। সরকারপ্রধানের ক্ষমতার কোনো সীমারেখা নেই এবং তিনি সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতাবদল বা সরকার বদলের পথ রুদ্ধ, অর্থাৎ নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধান মোতাবেকই অকার্যকর। রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের কাজ সরকারের ইচ্ছার অধীন। স্থানীয় শাসনকেই স্থানীয় সরকার হিসেবে চালিয়ে দেওয়া। সংসদ, অর্থাৎ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাহী বিভাগের অধীন করে রাখা। রাষ্ট্র পরিচালনার দমনমূলক ঔপনিবেশিক আইনগুলোকে অক্ষত রাখা এবং প্রশাসনকে বহাল রাখা। আরও অনেক অনেক মৌলিক দুর্বলতা আছে। তবে এর সবকিছুকে খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’র সঙ্গে ক্ষমতাকাঠামোর বৈপরীত্য। যে ধরনের ক্ষমতাকাঠামো এসব মূলনীতি বাস্তবায়নে কার্যকর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তেমন একটি ক্ষমতাকাঠামোই সাংবিধানিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। উপরন্তু মূলনীতিতেই বলা হয়েছে, [অনুচ্ছেদ ৮(২)] এসব মূলনীতি মানতে সরকারকে আইনানুগ পথে বাধ্য করা যাবে না। ফলে যে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে বলে বিশ্বাস করেছে, বাহাত্তরের সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের বাধা হিসেবে আবির্ভূত হযেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে এ সংবিধান একটি সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

প্রশ্ন

এ পর্যন্ত সংবিধান ১৭ বার সংশোধন হয়েছে। জনগণের প্রয়োজনে কতবার আর শাসকদের সুবিধার জন্য কতবার? আপনার মতে সবচেয়ে বিপজ্জনক সংশোধনী কোনটি বা কোনগুলো?

হাসনাত কাইয়ূম: মোটাদাগে তিনটি সংশোধনীকে জনগণের পক্ষের সংশোধনী হিসেবে ধরা যায়। প্রথম সংশোধনী, তিয়াত্তর সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথকে সুগম করার জন্য আনা হয়। একাদশ সংশোধনী, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে পুনরায় প্রধান বিচারপতি পদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এ সংশোধনী আনা হলেও এটিই একমাত্র সংশোধনী, যেখানে সরকারকে অবৈধ এবং জনগণের আন্দোলনকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী, এ সংশোধনীতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য, বাহাত্তরের সাংবিধানিক স্কিমের বাইরে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই তিন সংশোধনী ছাড়া বাকি প্রায় সব সংশোধনীই শাসকদের কোনো না কোনো অংশ তাদের ক্ষমতাচর্চাকে আরও মসৃণ করার জন্যই পাস করেছেন।

প্রশ্ন

বিভিন্ন সময় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি উঠেছে। আপনি কি মনে করেন এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মূল চেতনা ধ্বংস করা হয়েছে?

হাসনাত কাইয়ূম: হ্যাঁ, আমিও তা–ই মনে করি। ব্রিটিশ–পরবর্তী পাকিস্তানি কাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য সংবিধান ছিল আইয়ুব খানের বাষট্টি সালের সংবিধান। সেই সংবিধানেও প্রেসিডেন্টকে (প্রধান নির্বাহী) ইমপিচ (অভিশংসন) করার বিধান ছিল, কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গচ্ছিত রাখা হলেও প্রধানমন্ত্রীকে কোন কারণে অভিশংসন করা যাবে, এমন কোনো শাব্দিক প্রকল্পও রাখা হয়নি। ৫৫(৩) অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকবে, এ কথা বলা হলেও ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদকে উল্টো প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়ী বা বন্দী করে ফেলেছে। ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে এখানে সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রশ্ন

সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল কথা হলো, সম্মিলিত দায়বদ্ধতা। অর্থাৎ পুরো মন্ত্রিসভা জাতীয় সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। আমাদের এখানকার বাস্তবতা কী?

হাসনাত কাইয়ূম: আমাদের এখানকার বাস্তবতা আমরা প্রত্যেকেই জানি, কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে এই বাস্তবতা সাংবিধানিকভাবেই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ মনে করে, দেশ সাংবিধানিকভাবে চলছে না এবং এখানে আইনের শাসন নেই। এ ধরনের মিথগুলো ভয়াবহ রকম ক্ষতিকর।

প্রশ্ন

বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালি ছাড়া আর কোনো জাতিসত্তাকে স্বীকার করেনি। পরে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এটি কি তাদের জন্য অপমানকর নয়?

হাসনাত কাইয়ূম: এই অস্বীকার যতটা অবমাননাকর, তার তুলনায় অনেক অনেক বেশি ক্ষতিকর। আমাদের সংবিধান মালিকানার তিনটি ধরনের স্বীকৃতি দিয়েছে: রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী এবং ব্যক্তিগত। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসকারী অনেক জাতিগোষ্ঠী মালিকানার এই তিন ধরনে বিশ্বাসী নয়। তারা সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী এবং অনুসারী। তাদের জাতিসত্তাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অর্থ হলো, তাদের মালিকানার চর্চাকে স্বীকৃতি না দেওয়া। সংবিধান মালিকানার তিন ধরন তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে তাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

এ ছাড়া বাঙালিরা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। সেই জাতি নিজে অন্য জাতিসত্তাকে অস্বীকার করলে নিজেরা তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দার্শনিক ন্যায্যতা হারায়। তাই এটা বাঙালিদের জন্যও লজ্জার।

প্রশ্ন

আমাদের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, মিলাদ পড়া ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো কাজ নেই। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা উচিত বলে মনে করেন?

হাসনাত কাইয়ূম: আমাদের সংবিধান অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রপতি মিলাদ পড়া কিংবা কবর জিয়ারতের কাজও স্বাধীনভাবে বা তাঁর নিজের ইচ্ছায় করতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ একজন রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শবাহীতে পরিণত করে রেখেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করা। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য তো লাগবেই, এ ছাড়া আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যেও ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে।

প্রশ্ন

আমাদের এখানে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে আনুপাতিক ভোটব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছেন, যাতে ছোট ছোট দলও শাসনকাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। পশ্চিমের অনেক দেশেই আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা আছে।

হাসনাত কাইয়ূম: দ্বিদলীয় ব্যবস্থার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শুধু নয়, দেশের প্রকৃত মালিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য এ নির্বাচনব্যবস্থা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠরা রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকারী বলে যে মত চালু আছে, বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থা তার পরিপন্থী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করে। বাংলাদেশে যারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে, তারা প্রায়ই ৩১ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এতে ৬০ শতাংশ বা তদূর্ধ্ব মানুষ সরকারে তার প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হয় এবং যারা সরকার গঠন করে, প্রথম থেকেই তারা তাদের সমর্থকদের চেয়ে বড় অংশকে মোকাবিলা করে শাসন চালাতে গিয়ে পুলিশ, আমলা, দলীয় গুন্ডা-মাস্তানদের ওপর নির্ভরশীল হয়। এমন প্রক্রিয়া জারি রাখতে তারা প্রায়ই নিজের দলের নিবেদিত, পরীক্ষিত, ত্যাগী, সৎ, মানবতাবাদী, দেশপ্রেমিক নেতাদের বদলে গুন্ডা, মাস্তান, অবৈধ সম্পদের মালিকদের কাছে নমিনেশন ছেড়ে কিংবা বিক্রি করে দিতে উৎসাহিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্য হয়। তাই সবার স্বার্থেই এ নির্বাচনব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ—এ দুই পদ্ধতির সমন্বয় করা উচিত।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

হাসনাত কাইয়ূম: আপনাকেও ধন্যবাদ।