উচ্চশিক্ষাকাঙ্ক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থার নয়া ইশতেহার

উচ্চশিক্ষাকে টেকসই করার লক্ষ্যেই চলমান আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য কী এবং কীভাবে ও কার জন্য এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে, উচ্চশিক্ষা নিয়ে ধারাবাহিক লেখার এটি দ্বিতীয় পর্ব। লিখেছেন সৌমিত জয়দ্বীপ

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও উন্নয়নবাদের মোড়কে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি একটি আসমুদ্রহিমাচল আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। এ জন্যই একে বলা হচ্ছে ‘উচ্চশিক্ষাকাঙ্ক্ষা’। আকাঙ্ক্ষা থাকা উপাদেয়। তবে ভৌত ‘বিশ্ববিদ্যালয়বাজি’র কারসাজিতে দাঁড়ানো বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার চরিত্রটি বাজারকেন্দ্রিক হওয়ায় তা সহজলভ্যতার নেশায় মত্ত অপরিকল্পনা ও অনুৎপাদনশীলতার আস্ফালনমাত্র।

টাকা প্রয়োজনের অধিক ছাপানো যেমন মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়, তেমনই টেকসই উচ্চশিক্ষার দর্শনহীনতার বদলে যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুললে তা ‘উচ্চশিক্ষাস্ফীতি’ এবং একই সঙ্গে ‘বেকারস্ফীতি’ তৈরি করে। এতে অতি-উৎপাদনে মুদ্রার মতো উচ্চশিক্ষারও মান কমে। উচ্চশিক্ষাকে টেকসই করার লক্ষ্যেই চলমান আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য কী এবং কীভাবে ও কার জন্য এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে।

এরপর আসবে উচ্চতর শিক্ষার প্রসঙ্গ। অপ্রিয় হলেও সত্য, উচ্চতর শিক্ষার সর্বজনীনতা বাঞ্ছনীয় নয়। বরং একজন নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য ও প্রয়োজনীয় টেকসই উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্তের মাধ্যমে তাঁকে বাজারব্যবস্থার অংশীদারত্ব দিতে হবে। বাজারের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে এসে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারার এটাই বোধ হয় সবচেয়ে উত্তম ‘বটিকা’। সেই ভাবনা থেকেই এ ইশতেহারের প্রস্তাব।

না, এ প্রস্তাব অলৌকিক আকাশকুসুম কল্পনা নয়। এর বাস্তব অস্তিত্ব খোদ বাংলাদেশেই আছে। উদাহরণ চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সশস্ত্র বাহিনীর শিক্ষাকাঠামো।

চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সশস্ত্র বাহিনীর শিক্ষাকাঠামো

উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা শীর্ষ মেধাবীদের বৃহদাংশের স্বপ্ন থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নের। এই মেধাবীরা পড়েন মহাবিদ্যালয় তথা কলেজে, যেগুলো কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত।

সশস্ত্র বাহিনীতে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে চাকরির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আছে। যেমন সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোর্স শেষে একজন অফিসার লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পান। এই স্নাতক সমপর্যায়ের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়াটির আনুষ্ঠানিক তকমা ‘প্রশিক্ষণ’।

হায়, বাংলাদেশে শীর্ষ মেধাবীরা অধিভুক্ত কলেজে পড়েন! হায়, স্নাতক পর্যায়ের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাগ্রহণ কি না প্রশিক্ষণ! বাংলাদেশে মহাবিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রিক শিক্ষাকে যেভাবে ব্রাত্যজ্ঞান করে একই দেশে দুই নীতির উচ্চশিক্ষা প্রচলিত আছে, সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ দুটি উদাহরণই সম্ভবত যথেষ্ট।

তাহলে কি কলেজেই হবে উচ্চশিক্ষা

সারা দুনিয়ায় কলেজিয়েট পদ্ধতির উচ্চশিক্ষা বেশ সম্মানজনক। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এত সরল মনে সম্মানের পথ খুঁজব না। এ ব্যাপারে সমাধান খুঁজতে আমাদের বরাবর সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থাকে, যেটির মুখোশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও মুখটি কলেজিয়েট-ব্যবস্থার।

মোটাদাগে এ ব্যবস্থায় গবেষণার অবস্থা তথৈবচ, বিভাগ-বিভাজিত বিশেষায়িত পঠনপাঠন বাজারের চাপে নতজানু এবং চাকরিপন্থী ধারার একাধিপত্যে যুযুধান জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারাটি মুমূর্ষু ও পরাভূত। জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারাটির প্রকৃত মূল্যায়নে মনোযোগ দিতে হবে গবেষণায় এবং অনিবার্যভাবেই মহাবিদ্যালয়রূপী বিশ্ববিদ্যালয়-কাঠামো ভেঙে গড়তে হবে উচ্চতর শিক্ষার প্রকৃত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়।

জাতীয় গবেষণা ও সনদদাতা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে ন্যূনতম একটি স্বতন্ত্র গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার বিষয়টি নিয়ে তেমন বিদ্যায়তনিক উচ্চবাচ্য নেই। এর সকরুণ কারণও আছে। ঔপনিবেশিক মনোজগতের প্রকৃষ্ট উত্তরসূরি হিসেবেই বাজারব্যবস্থার চাপে-তাপে-উত্তাপে উচ্চবিদ্যাপীঠের স্নাতকদের মধ্যে চাকরিপন্থী, বিশেষত সরকারি চাকরিপন্থী ধারাটি এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক আধিপত্যবাদী।

শিক্ষার্থীদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান-উদ্দেশ্য চাকরিপন্থী হয়ে উঠলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শিক কাঠামো যে সংকটাপন্ন হয়, তা সম্ভবত বিবিধ রাজনৈতিক সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত বাংলাদেশিরা খুব কমই ঠাওর করতে পেরেছেন। চলমান পাঠন ও গবেষণাকাঠামোর বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় গবেষণা-সংক্রান্ত সংকট তাই আরও গভীরে নিপতিত হয়েছে।

বাংলাদেশে গবেষণা হয় মুখ্যত (পিএইচডি, এমফিল বা গবেষণাপত্র লেখা) পদোন্নতির আশায়। ফলে নতুন কী জ্ঞান উৎপাদিত হলো, তার জবাব খোদ গবেষকের কাছেই নেই! তথৈবচ মানহীন পিএইচডিতে জেরবার আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দুনিয়া। বহুজনের ‘গবেষকজীবন’ পিএইচডির পরেই অস্ত যায়।

গণ-‘উচ্চশিক্ষাকাঙ্ক্ষা’ যেমন প্রবল, তেমনই নামের ভূষণ ও অলংকার বাড়ানোর প্রকল্প হিসেবে পিএইচডি তথা উচ্চতর শিক্ষা লাভের আকাঙ্ক্ষাও দুর্বার! আদতে গবেষণা যা-ই হোক, লেবাসটা পরা চাই। ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়ন হলে একটি মহৎ একাডেমিক ডিগ্রিও তার জিম্মি হয়ে ওঠে। খোলা চোখে গবেষণা থাকলেও আদতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুসন্ধিৎসু গবেষণা নেই। স্বতন্ত্র গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় তাই সময়েরই দাবি।

আমাদের প্রস্তাব, নতুন কোনো উন্নয়নবাদী মহাপ্রকল্প গ্রহণ করে গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় উৎপাদনের প্রয়োজন নেই। বরং চলমান কাঠামোকে জুতসই করে বাংলাদেশের পুরোনো সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়—১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশভুক্ত ঢাবি-রাবি-চবি-জাবি এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে বুয়েট-বাকৃবি-বিএসএমএমইউকে (পিজি) গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হোক।

এগুলো প্রকৃতার্থেই উচ্চতর জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে গড়তে তত্ত্বাবধায়ক ও শিক্ষকদের ওপর চেপে থাকা ক্লাস-পরীক্ষার জগদ্দল পাথরটিকে ভাঙতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ের পঠনপাঠন বন্ধ করে শুধু ‘রিসার্চ মাস্টার্স লিডিং পিএইচডি’র কার্যক্রম চালু হোক।

বলাবাহুল্য, বিএসএমএমইউতে এমনিতেও স্নাতক নেই, বরং অনেক মেডিকেল কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকার সাতটি বড় কলেজ ও কিছু মেডিকেল কলেজ কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সারা দেশের অপরাপর কলেজগুলো যেমন, প্রস্তাবিত ইশতেহারে অধিভুক্তির ফ্রেমওয়ার্কটিও অনেকটা তেমনই।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি বাংলাদেশে এখন যেভাবে প্রচলিত আছে, সেটিও এই সুবাদে বদলাতে হবে। প্রস্তাবিত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই ‘পাওয়ার অব অ্যাফিলিয়েশন’ তথা সনদ প্রদানের ক্ষমতা দিতে হবে। মূলত এই প্রতিষ্ঠানগুলোই হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং আনুষ্ঠানিক নাম হবে ‘জাতীয় গবেষণা ও সনদদাতা বিশ্ববিদ্যালয়’। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক বিদ্যায়তনিক কাজ গবেষণা এবং আনুষঙ্গিক প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজ হবে সনদ প্রদান। সনদীয় শিক্ষাদর্শের যুগে শিক্ষার্থীদের সনদের মূল্যও এতে বাড়বে বৈ কমবে না!

বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের স্ট্যাটাসে থাকবে বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বারোয়ারি (পাবলিক) ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে’র মর্যাদায় অভিষিক্ত করলে সব মিলিয়ে এমন বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে ১৫টি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায় থাকুক আপাতত। কিন্তু গন্তব্য হোক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনীন পার্থক্য হবে—বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সনদ প্রদানের ক্ষমতা থাকবে না।

প্রতিষ্ঠার ক্রমানুসারে ১০টি বারোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়—কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাবিপ্রবি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত হবে।

এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগ হবে কয়েকটি মানসম্পন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি ধাপে ধাপে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর কথা ভাবছে। সে ক্ষেত্রে ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, ইউল্যাব, আইইউবি, আহসানউল্লা প্রভৃতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই ট্র্যাক-রেকর্ড অনুযায়ী ‘বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে’র স্ট্যাটাস পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগণ্য বিবেচিত হতে পারে।

প্রত্যন্তের উচ্চশিক্ষাকাঙ্ক্ষার স্নাতক বিদ্যাপীঠ

জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়বাজির উদ্বেগ জানিয়ে আগেই বলেছি, যেকোনো মূল্যে মহাবিদ্যালয়রূপী বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যবস্থার মূলকে উৎপাটন করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এত এত নবগঠিত ‘বারোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়’, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরোনো প্রতিষ্ঠিত মহাবিদ্যালয়গুলো কি বন্ধ হয়ে যাবে? না, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষায়িত বিদ্যাপীঠ বা ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করতে হবে।

ভারতের আইআইটির বাংলাদেশ শাখা খোলার কথা শোনা যাচ্ছে এবং কিছুদিন পর বলা হবে, আইআইএমও খোলা হবে। এগুলো একদমই নিষ্প্রয়োজন। সদিচ্ছা থাকলে আমরাই ওই বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোকে বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটে রূপ দিতে পারি। আমাদের প্রয়োজন যথার্থ কর্মমুখী শিক্ষা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতো কৃষি, ফার্মেসি, ব্যবসায় প্রশাসন, কম্পিউটারবিজ্ঞান, আইটি, বিবিধ প্রকৌশল ও কারিগরি বিদ্যা, সাংবাদিকতা ইত্যাদি বহু বলা না-বলা বিশেষায়িত কর্মমুখী শিক্ষার জন্য বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট খোলার ভাবনা আমাদের থাকতে হবে।

এই ইনস্টিটিউটগুলো তিন বা চার বছরের স্নাতক পড়াক ‘জাতীয় গবেষণা ও সনদদাতা বিশ্ববিদ্যালয়’গুলোর অধিভুক্ত হয়ে। মাস্টার্স উঠিয়ে দিয়ে এগুলোকে শুধু স্নাতক পর্যায়ভুক্ত বিদ্যাপীঠ করা হোক। এগুলো না হবে মহাবিদ্যালয়, না হবে বিশ্ববিদ্যালয়—এগুলো হবে ‘হায়ার ইনস্টিটিউট’ বা ‘হায়ার কলেজ’ বা ‘গ্র্যাজুয়েট কলেজ’ বা ‘স্নাতক বিদ্যাপীঠ’। এভাবে উচ্চশিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের উচ্চশিক্ষাকাঙ্ক্ষাকে ফলবান বৃক্ষে পরিণত করতে হবে।

এই বিদ্যাপীঠগুলো বাজারমুখী শিক্ষার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। বেকারস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী। প্রতি তিন-চার-পাঁচ বছরে কোন খাতে কী পরিমাণ জনশক্তি প্রয়োজন, সে অনুযায়ী স্নাতক তৈরি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে একটি শিক্ষাবর্ষে কোনো কোনো বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রয়োজন না-ও হতে পারে, এটি গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে।

এই ইশতেহারের ফ্রেমওয়ার্কে বর্তমানে প্রচলিত অনুৎপাদনশীল স্নাতক তৈরির কারখানা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে প্রচলিত ঔপনিবেশিক আমলের ডিগ্রি পাস কোর্স পরিপূর্ণভাবে বন্ধের প্রস্তাব রাখা হলো। কলেজগুলো শুধু উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্তই পড়াবে, প্রয়োজনে মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এ প্রক্রিয়ায় বাজারব্যবস্থা পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তি উৎপাদন করতে পারলে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ বেঁচে যাবে, যা গবেষণা খাতে উচ্চ বরাদ্দকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

বাজার ও লোকপ্রশাসন বিদ্যাপীঠ

বাজারের সবচেয়ে বড় ‘সোনার হরিণ’ হলো সরকারি চাকরি তথা বিসিএস। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাম্প্রতিক ‘বোমা বিস্ফোরণ’ বিসিএসকে কলঙ্কিত করেছে ঠিক, কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনও একে যথাযথভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। কেননা, বিসিএস ক্যাডারের গণ-আবেদন এতটাই আকাশচুম্বী যে এর গায়ে কলঙ্কতিলক ভাবী চাকরিজীবীরাও লাগতে দিতে চান না!

সরকারি চাকরির এই বাজারপ্রিয়তা উচ্চশিক্ষার মৌলিক দর্শনকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো বিপিএটিসিকে ‘লোকপ্রশাসন বিদ্যাপীঠে’ রূপান্তর করা কিংবা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যার সনদদাতা হবে প্রস্তাবিত নয়া ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’। যাঁরা সিভিল সার্ভিসে আসতে চান, তাঁরা উচ্চমাধ্যমিকের পরপরই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভর্তি পরীক্ষা বা সশস্ত্র বাহিনীর নিয়োগের মতো করে এই প্রতিষ্ঠানে তিন-চার বছরের স্নাতক পড়ার ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হোন।

কেবল এ বিদ্যাপীঠই হোক সরকারি চাকরি তথা বিসিএসের প্রবেশদ্বার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লোকপ্রশাসন বা জনপ্রশাসনের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এই লোকপ্রশাসন বিদ্যাপীঠ ‘ম্যাকলে চিলড্রেন’ আমলাদের সন্তানের জন্য অযৌক্তিকভাবে দাবিকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা না মেটালেও উচ্চশিক্ষাকাঙ্ক্ষাকে অনুৎপাদনশীল হওয়ার হাত থেকে অবশ্যই বাঁচাবে।

‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ...’

একাডেমিয়ায় পেশা না গড়লে চাকরির জন্য শুধু স্নাতকের সনদই যথেষ্ট—রাষ্ট্রকে এই সর্বজনীন বিধি প্রচলন করতে হবে। তবু চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্নাতকোত্তর সনদধারী প্রয়োজন হলে তারা নিজস্ব আর্থিক উদ্যোগে তাদের চাকরিজীবীদের পড়াবে দেশে কিংবা বিদেশে। দেশে এই দায়িত্ব থাকবে বিভাগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর।

অন্যদিকে উচ্চতর শিক্ষার জাতীয় গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে শিক্ষক-গবেষক তৈরির নিউক্লিয়াস। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক হিসেবে যাঁরা ক্যারিয়ার গড়তে চান বা গড়বেন, তাঁরাই এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের যোগ্য হয়ে উঠবেন স্নাতক পাসের পর।

আদতে এই গবেষণাকেন্দ্রিক কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পাঠন ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাকে বাজারের দাসত্বমুক্ত করার আকাঙ্ক্ষাতেই এই নয়া ইশতেহারের প্রস্তাব। এই ইশতেহারের ভিত্তিভূমি তথা ফ্রেমওয়ার্কটির নাম ‘টেক্সোনমি অব হায়ার এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’।

এই ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়ন ও উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে বদলানোর জন্য তিনটি বিষয় খুবই জরুরি। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক ও শিক্ষক নিয়োগের প্রচলিত পদ্ধতির আমূল সংস্কার ও কর্মবিধিসংক্রান্ত সাংবিধানিক ধারা সংশোধন (যেমন অনুচ্ছেদ ২১, ১৩৩ ও ১৩৬ ইত্যাদি); দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন সুনিশ্চিতকরণ এবং তৃতীয়ত, সর্বত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিপূর্ণ আবাসিক চরিত্র ও জেনারেল এডুকেশনের আওতায় লিবারেল আর্টস তথা সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পঠনপাঠন প্রচলন। আর সর্বৈবভাবে প্রয়োজন যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নে নীতিনির্ধারকদের সৎ ও আন্তরিক প্রচেষ্টাসহ বুদ্ধিবৃত্তিক মতামতকে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করা।

  • ড. সৌমিত জয়দ্বীপ সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়