চার দফায় প্রায় ২৪ বছর রাশিয়ার ক্ষমতায় পুতিন। কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, কখনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে। সি চিন পিং চীনে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আছেন এক দশকের বেশি। উভয়ে মাঝেমধ্যে ‘নির্বাচিত’ হন। ক্ষমতায় থাকতে এসব ‘নির্বাচন’ কোনো ঝুঁকি তৈরি করে না। তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে কারও রাজনীতির মাঠে নামার সুযোগই ক্ষীণ।
এ রকম ‘চমৎকার’ ব্যবস্থা ‘গণতান্ত্রিক বিশ্বে’র কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষে বছরের পর বছর চালু রাখা কঠিন। ফলে মূলধারার ওই বিশ্বব্যবস্থা থেকে সি ও পুতিন ভিন্ন ব্যবস্থা গড়তে আগ্রহী। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্টের মস্কো সফরের ভেতর দিয়ে উভয় নেতার ওই নতুন ‘বিশ্বব্যবস্থা’র সাধনা শক্ত জমিন পেল বলে ভূরাজনীতিবিদেরা জানাচ্ছেন। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের ভঙ্গুর দেহে মোটা একটা পেরেক ঠোকার মতো ব্যাপার হলো এটা।
সি ও পুতিন এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৪০ বার দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। নতুন করে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হয়েও সি প্রথমে মস্কো গেলেন আবার। ২০ মার্চ শুরু হওয়া এ সফরের আগে বিশ্বজুড়ে মরীচিকা তৈরি হয়েছিল—চীন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে পুতিনকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে। গত মাসে ‘১২ দফা’ শান্তি প্রস্তাব বাজারে ছেড়ে তারা এ রকম একটা ধোঁয়াশা তৈরি করে। অথচ সি মস্কো ঘুরে আসার পর বোঝা গেল, ব্যাপারটা অত আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নয়।
চীন ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নয় এবং এই পুতিনের অমর্যাদা হয়, এমন কোনো ভঙ্গিতে যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টাতেও নেই। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনে চীন এত দিনকার অস্পষ্ট মধ্যপন্থা থেকে এখন বরং রাশিয়ার দিকে আরেক কদম সরেছে। ক্রেমলিনে বসে উভয়ে ‘কৌশলগত সম্পর্কে’ আবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
তবে চীনের অবস্থান বেশ নির্মম কিন্তু স্পষ্ট—তারা রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রীকে ‘জোট’ বা ‘ইউনিয়ন’-এর আদল দিতে অনিচ্ছুক। অর্থাৎ রুশদের তারা নিজস্ব ‘উপগ্রহ’ আকারে রাখতে চায়, বাড়তি কোনো অঙ্গীকারে জড়াতে চায় না। তবে উভয় শক্তি এবার নতুন শব্দ ব্যবহার করে বলেছে, তাদের বন্ধুত্বের পরিসর হবে ‘সীমাহীন’। এ রকম দুই বন্ধু ইউক্রেন সংকট বন্ধে ‘যুদ্ধরত দুই পক্ষের দায়িত্বশীল সংলাপ’ চেয়েছে কেবল। যা বিশ্ববাসীর জন্য শূন্যগর্ভ শব্দ ছাড়া আর কোনো তাৎপর্য বহন করছে না আপাতত।
সির সফরে রাশিয়ার অগ্রাধিকার ছিল ‘অর্থনীতি’। গত বছর উভয়ে ১৯০ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন করেছেন। চীনমুখী রুশ জ্বালানির প্রবাহ দ্বিগুণ বেড়েছে। মস্কো এ রকম অগ্রগতি আরও বাড়াতে ও বহুমুখী করতে চায়। পশ্চিমা অবরোধের মুখে চীনের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানো রাশিয়ার জন্য অতি জরুরি। কিন্তু যেটা বিশেষভাবে দেখার মতো, সির সফরে চীন ব্যবসার আলাপ করলেও বিনিয়োগের আলাপ কমই করেছে। তবে অর্থনীতির বাইরে সি রুশদের রাজনৈতিক সম্মান বাঁচিয়েছে অনেকখানি। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পুতিনের ইমেজে যে নৈতিক কলঙ্ক পড়ে, সি চিনের সফর তাতে কিছু প্রলেপ দিয়ে এল।
পরোয়ানা জারির পরদিনই সির মুখে পুতিনের উদ্দেশে ‘বন্ধু’ ডাক রুশ গোলায় ছত্রভঙ্গ ইউক্রেনবাসীর কাছে নিশ্চয়ই বেশ তিক্ত শুনিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সির এ সফর ২০২৪-এ আরেক দফা প্রেসিডেন্ট হতে পুতিনকে সহায়তা করবে। রুশ অভিজাতদের তিনি বলতে পারবেন, পশ্চিমের ঘৃণা-বিদ্বেষ সত্ত্বেও তিনি একা নেই। তবে ব্যক্তি পুতিনের লাভালাভের বাইরে রুশদের জন্য একটা উদ্বেগের দিক হলো, পশ্চিমাদের হাত থেকে অর্থনীতি বাঁচাতে গিয়ে তারা মাত্র এক বছরে চীনের ওপর বিপজ্জনকভাবে নির্ভরশীল হয়ে গেছে। যেকোনো অসম সম্পর্কে দুর্বল যেভাবে সবলের অনুগত হয়ে ওঠে, রাশিয়ার ভবিতব্য এখন ও রকম।
ইউক্রেনে সামরিক অসফলতা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি ঘোষণার পর পুতিনের কিছুটা কোণঠাসা অবস্থা চলছিল। এ অবস্থায় সি মস্কো গিয়ে পুতিনকে নৈতিকভাবে মদদ দিয়ে আসায় সবচেয়ে হতাশ হয়েছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। তারা খানিক ভীতও। পুতিন এখন হয়তো বাড়তি আগ্রাসী মনোভাব দেখাবেন। সির সফরের পরপর তিনি বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রতিবেশীদের মধ্যে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো হলেন পুতিনের নির্ভরযোগ্য বন্ধু। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর লুকাশেঙ্কো আর কাউকে প্রেসিডেন্ট হতে দেননি, ২৯ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। একসময় রুশ সেনাবাহিনীতেই কাজ করতেন তিনি। এখন পুতিনের পাশে সিকে শক্তভাবে দাঁড়াতে দেখে লুকাশেঙ্কো যেভাবে দেশকে রুশ পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার বানাচ্ছেন, তাতে ইউরোপে ভীতির নতুন তরঙ্গ উঠেছে। পুতিনের সর্বশেষ ঘোষণায় পুরোনো একটি বার্তা আরও পরিষ্কার হলো: বিশ্ব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের নতুন জমানায় প্রবেশ করে গেছে।
বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশে সি ও পুতিনের সমর্থক বামপন্থী তাত্ত্বিকদের প্রত্যাশা হলো এই দুই রাষ্ট্রনায়কের মৈত্রী বিশ্বকে ‘পশ্চিমা হেজিমনি’ থেকে মুক্ত করবে। অন্যদিকে চীন-রাশিয়া অক্ষশক্তিকে নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভয়—সি ও পুতিন মিলে ধীরে ধীরে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে পাল্টাতে চাইবেন এবং সেই চেষ্টা অন্তত চীনের দিক থেকে প্রকাশ্যে শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন-সংস্কৃতির সুনামিও বইছে। ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত বিশ্বায়নের স্বপ্ন ভেঙে পড়েছে।
কথিত ওই অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন থেকে মূলত গণচীনই লাভবান হয়েছিল এবং সেই ‘লাভে’র ওপর দাঁড়িয়ে তারা এখন দেশে দেশে তাদের সমর্থক ছোট ছোট স্থানীয় একদলীয় শাসক খুঁজছে। যাকে রাশিয়াসহ তারা বলছে ‘পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা’র বিকল্প। সংগত কারণেই নতুন এ বিশ্বব্যবস্থায় সব মহাদেশের খুদে ‘একনায়কেরা’ বাড়তি ভরসার জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন। গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক খবরদারি এড়াতে চীন-রাশিয়া তাঁদের জন্য বেশ নিরাপদ এক আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে।
ভারতের জন্যও মুহূর্তটা অস্বস্তির। চীনের সঙ্গে সীমান্তবৈরিতায় তারা নিশ্চিতভাবে রাশিয়ার দিক থেকে আগের মতো আর সহানুভূতি পাবে না। সংগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র সুযোগটি নিতে চাইবে। চীন-রাশিয়া ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’ মোকাবিলায় ওয়াশিংটনও নানা আয়োজন বাড়াচ্ছে এ অঞ্চলে। সময়টি তাই দক্ষিণ এশিয়ার জন্য দুর্ভাবনার।
সি ও পুতিনের নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশ সরাসরি বিপদের মুখে থাকবে মিয়ানমারের দিক থেকে। বেইজিং ও মস্কো বেশ কয়েক বছর ধরে নেপিডোর শাসকদের প্রধান ও দ্বিতীয় অস্ত্র সরবরাহকারী এবং কূটনৈতিক মদদদাতা। সি ও পুতিনের ‘সীমাহীন বন্ধুত্বে’র কালে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের জেনারেলদের আর বাধ্য করতে পারবে বলে মনে হয় না। বরং ভূরাজনীতির উদীয়মান বাস্তবতায় রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট কোনো পরিকল্পনাই চীন-রাশিয়া সামনে নিয়ে আসতে পারে যেকোনো সময়।
ভারতের জন্যও মুহূর্তটা অস্বস্তির। চীনের সঙ্গে সীমান্তবৈরিতায় তারা নিশ্চিতভাবে রাশিয়ার দিক থেকে আগের মতো আর সহানুভূতি পাবে না। সংগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র সুযোগটি নিতে চাইবে। চীন-রাশিয়া ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’ মোকাবিলায় ওয়াশিংটনও নানা আয়োজন বাড়াচ্ছে এ অঞ্চলে। সময়টি তাই দক্ষিণ এশিয়ার জন্য দুর্ভাবনার।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক