মতামত

পুতিনকে আগে কখনো এতটা বিচলিত দেখায়নি

ভ্লাদিমির পুতিন
ভ্লাদিমির পুতিন

গেল কয়েক মাস ধরেই ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিন রুশ সেনানায়কদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করে আসছেন। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সর্বাধিনায়ক ভ্যালেরি গেরাসিমভকে যাচ্ছেতাই ভাষায় বকাঝকা করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ইউক্রেন যুদ্ধে অদক্ষতারও অভিযোগও তুলেছেন প্রিগোশিন।

একটি ভিডিওতে প্রিগোশিনকে তাঁর নেতৃত্বাধীন ভাড়াটে যোদ্ধাদের দল ভাগনারের সৈন্যদের মৃত্যুর জন্য মস্কোকে দায়ী করতেও দেখা গেছে।  সৈন্যদের মৃতদেহের স্তূপ পেছনে রেখে প্রিগোশিন ওই ভিডিও তে হাজির হন। একটি চিঠিতে তিনি শোইগুকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ দেন। পুব দিকের শহর বাখমুতে ভাগনাররা তখন যুদ্ধ করছেন আর সমানে মারা পড়ছেন। প্রিগোজিন এসব মৃত্যুর জন্য রুশ সেনাবাহিনীকে দায়ী করছেন।

মস্কো যখন সন্ত্রাসবিরোধী নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে, তখন ভাগনাররা ব্যস্ত ছিলেন রোস্তভের সামরিক স্থাপনাগুলো দখলে। প্রিগোশিন ও শোইগুর মধ্যে বিরোধ আপাতদৃষ্টে বাস্তবিক। কিন্তু পুতিনের অভেদ্য শাসনব্যবস্থায় এ কথা বলা নিষেধ। তাঁর এই শাসনব্যবস্থা অটোম্যানদের মতো, পশ্চিমা দেশগুলোর মতো নয়।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পুতিনই দেশটিতে প্রধান সালিসকারীর ভূমিকায়। ক্রেমলিনে যখনই একাধিক শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছে তখনই তিনি সালিসকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অতীতে প্রিগোশিন নিজেকে পুতিনের অনুগত মিত্র হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তিনি ২০১৬ সালে আমেরিকার নির্বাচন বানচাল প্রচেষ্টার মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বও পেয়েছেন।

গত ১২ ঘণ্টায় যা ঘটেছে তাতে করে ক্রেমলিনের সঙ্গে প্রিগোশিনের আর কোনো চুক্তি যে নেই তা নিশ্চিত। প্রিগোশিন চান শোইগু এবং শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হোক।

অধিকৃত পূর্ব ইউরোপ থেকে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত ভাগনাররা একরকম বিনা বাধায় রাশিয়ায় ঢুকে পড়েছেন। রোস্তভ-অন-দনের বেশির ভাগ ভবন এখন ভাগনারদের দখলে বলে মনে হচ্ছে। এটি সামরিক বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় সদর দপ্তর। এখানে মস্কোর তথাকথিত ‘বিশেষ সেনা অভিযানের’ রসদও জমা থাকে।

রাশিয়ার এই পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতূহলোদ্দীপক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ভাগনারদের ঘাঁটি মূলত অধিকৃত লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলে। ভাগনার সৈন্যদের কিছু অংশ গত ২৪ ঘণ্টায় এসব অঞ্চল ছেড়ে রাশিয়ায় ফিরেছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী বাখমুতের বেশ কিছু অঞ্চল ইউক্রেন পুনর্দখল করে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ভীত-সন্ত্রস্ত রুশ জেনারেলরা প্রিগোশিনকে তাঁর দাবি পরিত্যাগ এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সরকারি কার্যালয়ে অভ্যন্তরীণ আক্রমণ প্রতিহত করতে এখন মস্কোর রাজপথে সাঁজোয়া যান চলছে।

এই পরিস্থিতি ১৯৯১ এর গ্রীষ্মে অসফল কিন্তু বিস্ময়কর সেই অভ্যুত্থানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কমিউনিস্টদের টিকিয়ে রাখতে কেজিবির কট্টরপন্থীরা ওই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। ওই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করে। কয়েক মাসের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে।  

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এবারও হবে কি না তা বলার সময় আসেনি এখনো আসেনি। প্রিগোশিন শান্তিবাদী নন। তিনি ইউক্রেনে আরও জোরালো যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য তিনি শীর্ষ পর্যায় থেকে যুদ্ধ নিয়ে আরও সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত ও আরও সততা চান। তিনি চান আরও কমসংখ্যক সৈন্যের প্রাণহানি ঘটুক এবং হামলা হোক সুপরিকল্পিত।

শোইগুর বিরুদ্ধে প্রিগোশিনের অভিযোগ, যুদ্ধে তিনি (শোইগু) রুশ বাহিনীর প্রাণহানি নিয়ে মিথ্যে তথ্য দিচ্ছেন। গত বছর রুশ বাহিনীর পিছু হটা নিয়েও তিনি অসন্তুষ্ট। ওই সময় রুশ বাহিনী খেরসনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে খেরসনের কিছু অংশ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

শুক্রবারের এই বিস্ময়কর নাটকের ফল যাই হোক না কেন, ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পুতিনকে আর কখনো এত বিচলিত দেখায়নি। তাঁর ইউক্রেন দখলের সিদ্ধান্ত মূলত একটি কৌশলগত ভুল। এই ভুল এখন হোক কিংবা পরে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করবে।

প্রিগোশিনের অভ্যুত্থান শুরুর পর শনিবার সকালে পুতিন টিভিতে ভাষণ দেন। তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছেন এবং সন্ত্রাস-বিরোধী শাসন জারি করেছেন।

এই বিদ্রোহের সমাপ্তি যদি খুব দ্রুতও ঘটে, তারপরও এর প্রভাব থাকবে পরবর্তী মাসগুলোয়। এই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হতে পারে । প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে পুতিনের নেতৃত্বও। শেক্‌সপিয়ারের ম্যাকবেথের কথা মাথায় রাখলে, আমরা এখন পাঁচ নম্বর দৃশ্যে আছি।   

রাশিয়ার এই পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতূহলোদ্দীপক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ভাগনারদের ঘাঁটি মূলত অধিকৃত লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলে। ভাগনার সৈন্যদের কিছু অংশ গত ২৪ ঘণ্টায় এসব অঞ্চল ছেড়ে রাশিয়ায় ফিরেছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী বাখমুতের বেশ কিছু অঞ্চল ইউক্রেন পুনর্দখল করে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

প্রিগোশিনের ভাড়াটে ও স্বেচ্ছাসেবী সৈন্যদের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং পরে মুক্ত হয়েছে এমন ব্যক্তিরা রয়েছেন। তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল। তাঁরা এখন অধিকৃত অঞ্চল থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছেন এবং নজর দিচ্ছেন রাশিয়ার ওপর।

প্রিগোশিনের এই ক্ষমতা দখলের চেষ্টা যুদ্ধের হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিচ্ছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে গুরুত্ব না দেওয়াটা বোকামি। তবে এই গ্রীষ্মে ইউক্রেনের দারুণভাবে ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হলো। যদি সম্মুখ যুদ্ধে রাশিয়ার সৈনিকদের মনোবল ভেঙে পড়ে এবং তারা আর যুদ্ধ করতে না চায়, তাহলে দ্রুতই অধিকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।  

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ

  • লুক হার্ডিং ‘ইনভেশন: রাশিয়া’স ব্লাডি ওয়ার অ্যান্ড ইউক্রেনস ফাইট ফর সারভাইভাল’–গ্রন্থের লেখক