স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ‘অপর’ করে দেওয়ার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল উপনিবেশ। একসময় আমেরিকাজুড়ে নানা গোত্রের রেড ইন্ডিয়ানদের বাস ছিল। নদী, পাহাড়, বন, ভূমি—সবই ছিল তাদের অধিকারে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারীরা রেড ইন্ডিয়ানদের সেই ভূমিতে বসতি স্থাপন শুরু করে। নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হতে থাকে একেকটা রেড ইন্ডিয়ান গোত্র। নির্মম রক্তপাত, অবিমৃশ্য নিষ্ঠুরতা ও চরমতম অমানবিকতার সেই আখ্যান উঠে এসেছে মার্কিন জন-ঐতিহাসিক ডি ব্রাউনের ‘বারি মাই হার্ট অ্যাট দ্য উনডেড নি’ বইটিতে। ওয়েস্টার্ন সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্রে রেড ইন্ডিয়ানদের দানব, শত্রু কিংবা হামলাকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। অথচ ডি ব্রাউন ইতিহাসের নথি ঘেঁটে দেখিয়েছেন, উপনিবেশ স্থাপনের দেড় শ বছরের মধ্যে কীভাবে পুরো একটি ভূখণ্ড থেকে রেড ইন্ডিয়ানদের মেরে, কেটে, তাড়িয়ে কয়েকটি রিজার্ভেশন বা সংরক্ষিত এলাকায় বন্দী করে ফেলা হয়েছিল।
আলোকায়নের নামে ঔপনিবেশিকীকরণের সেই যুগ পেরিয়ে বিশ্বে স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠীকে অপর করে দেওয়ার সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কতটা মুক্ত হতে পেরেছে বিশ্ব? আমরা এখন যে ভূখণ্ডে বাস করছি, সেখানকার মানুষের উপনিবেশবিরোধী দীর্ঘ ও গৌরবজনক লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে। গত ৭৫ বছরে উপনিবেশের জোয়াল ভেঙে দু–দুবার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। কিন্তু কোনো এক বিস্ময়কর কারণে এ ভূখণ্ডে সব জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে একটা গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন চরমভাবে ব্যর্থ হতে হয়েছে। বাঙালি বাদ দিয়ে পাহাড় কিংবা সমতলের ৫০টিরও বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসীরা কতটা সম–অধিকার ও সমনাগরিক মর্যাদা ভোগ করতে পারছে?
কিছুদিন আগে প্রথম আলোর এক লেখকসম্মিলনীতে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কেন আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা হচ্ছে? আমাদের সবারই তো নির্দিষ্ট জাতিপরিচয় রয়েছে। আমরা কেউ চাকমা, কেউ মারমা, কেউ সাঁওতাল, কেউবা গারো। এখন বাঙালি কাউকে যদি বৃহৎ জাতিসত্তার মানুষ বলা শুরু করি, তাহলে কেমন হবে।’
আবুল বারকাত তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, গত ৬৪ বছরে সমতলের ১০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ২ লাখ ২ হাজার ১৬৪ একর জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যার দাম প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ফলে পাহাড় কিংবা সমতলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোকে অপর করে দেওয়ার এই রাজনীতির পেছনে মূল কারণ হচ্ছে ভূমি দখল। সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রভাবশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী– সবাই পাল্লা দিয়ে তা করে আসছে। রাষ্ট্রের তাতে পৃষ্ঠপোষকতা আর নীরব সমর্থন থাকছে।
সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্র যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের কাছে কি এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে? প্রশ্ন হলো, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কি কোনো জাতিগোষ্ঠীকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলার অধিকার পাওয়া যায়? পাহাড় ও সমতলের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও ক্রমাগত তাদের প্রান্তিকীকরণ একটি বাস্তব ও জীবন্ত সংকট। ভূমিতে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর যে প্রথাগত মালিকানার ধরন, সেটাকে পুঁজি করে ভূমি দখল চলে। অধিকারকর্মীদের অভিযোগ, ভূমিদস্যুরা ভূমি ব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে জাল দলিল করে হামলা, নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে তাদের উচ্ছেদ করছে আর সরকার উন্নয়নের নামে পার্ক, সাফারি পার্ক, ইকোপার্ক, পর্যটনস্পট, হোটেল-মোটেল করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে। রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নীতি এই প্রান্তিকীকরণে স্পষ্টত রসদ জোগায়। সাম্প্রতিক কালের তিনটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দেখে নেওয়া যাক।
১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বান্দরবানে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ম্রো-ত্রিপুরাদের তিনটি পাড়ার জমি দখল ও রেংয়েনপাড়ার পানির উৎসে কীটনাশক ছিটানোর প্রতিবাদে জেলা শহরে মানববন্ধন হয়েছে। মানবববন্ধনে বক্তারা বলেন, সেখানকার তিনটি গ্রামের ম্রো–ত্রিপুরাদের উচ্ছেদের জন্য লামা রাবার কোম্পানি বহু বছর ধরে তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির লোকজন গত ২৬ এপ্রিল ৩টি পাড়ার ৩৫০ একর জুমচাষের বনাঞ্চল কেটে পুড়িয়ে দিয়েছেন। রহস্যজনক কারণে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো বহিরাগত দখলদারদের হয়ে ভূমিপুত্রদের পাঁচ একর করে জমি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। অথচ পার্বত্য শান্তি চুক্তি অনুযায়ী, লামা রাবার কোম্পানির জমির ইজারা বহু আগে বাতিল হয়েছে। সর্বশেষ রেংয়েনপাড়ার ঝিরিতে পরিকল্পিতভাবে কীটনাশক ছিটানো হয়েছে।
গত ১২ মে প্রথম আলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য কামাল উদ্দিন আহমেদের বরাতে এক প্রতিবেদনে জানায়, বান্দরবানে ম্রো-ত্রিপুরাদের উচ্ছেদচেষ্টার সত্যতা পেয়েছে মানবাধিকার কমিশন। কামাল উদ্দিন বলেন, ‘রাবার কোম্পানিগুলো স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর রীতিমতো অত্যাচার শুরু করেছে। একধরনের ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে তাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। এবার রাবার কোম্পানিগুলোর হামলায় স্থানীয় অধিবাসীদের ঝরনাগুলোও নষ্ট হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
প্রশ্ন হলো, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এই প্রতিবেদনের পর ম্রো-ত্রিপুরাদের রক্ষায় সরকার কী ভূমিকা পালন করেছে? স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নিলে কি রাবার কোম্পানির লোকজন সেখানে গ্রামবাসীদের বেঁচে থাকার উৎস ঝিরিতে কীটনাশক ছিটানোর সাহস পেতেন? বাংলাদেশে ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু কমে গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। এর মূল কারণ, প্রাকৃতিক এসব উৎসের পানি নির্বিচারে দূষণ করছে পাহাড়ে বন্দোবস্ত নেওয়া অনেক কোম্পানি।
দিনাজপুর-৬ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক ও তাঁর চাচা দিনাজপুর জাতীয় পার্টির সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সাঁওতালদের জমি ও জীবনরক্ষা আন্দোলন’-এর ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় স্বপ্নপুরি নামের বিনোদনকেন্দ্রে সাঁওতাল ও মাহালি সম্প্রদায়ের তিনটি কবরস্থান আছে। একটি কবরস্থানের ওপর শিবলী সাদিক বাড়ি নির্মাণ করেছেন। স্বপ্নপুরি বিনোদনকেন্দ্রের স্বত্বাধিকারী দেলোয়ার হোসেন। তাঁকে ভূমিদস্যু আখ্যা দিয়ে বলা হয়, তিনি সাঁওতালদের ৭৭ দশমিক ১১ একর জমি দখল করেছেন। এলাকায় কোনো জমি নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে নানা কৌশলে সেই জমির মালিক হয়ে যান দেলোয়ার হোসেন। এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত সাঁওতালদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও জানানো হয়। প্রশাসনে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অভিযোগ দিলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। সাঁওতালরা জীবন ও জমি রক্ষার দাবি জানান।
৯ সেপ্টেম্বর জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৯ আগস্ট সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট মুন্ডাপল্লিতে হামলা চালায় স্থানীয় ভূমিদস্যুরা। হামলায় নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা নিহত হন। এ ঘটনায় ২২ জনকে আসামি করে মামলা হলেও পুলিশ মূল হোতাদের এখনো গ্রেপ্তার করেনি। মুন্ডাপল্লির বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাঁদের আট বিঘা জমি দখলের জন্য ওই হামলা চালানো হয়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এর পেছনে আছে বলে জানান তাঁরা।
নিহত নরেন্দ্রনাথ মুন্ডার ছেলে সনাতন মুন্ডা বলেন, ‘হামলা শুরুর পরই আমরা স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শুক্কুর আলীকে ফোন করি। কিন্তু তিনি আমাদের রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেননি। থানায় কয়েকবার ফোন করলেও পুলিশ আসেনি। পরে আমরা ৯৯৯-এ ফোন করলে যখন পুলিশ আসে, ততক্ষণে হামলাকারীরা চলে গেছে। তারা ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে এ হামলা চালায়।’
বান্দরবান, দিনাজপুর ও সাতক্ষীরার ঘটনা আপাত বিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও ভয়াবহ রকম যোগসূত্র রয়েছে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ক্রমেই প্রান্তে ঠেলে দেওয়া। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। ক্রমাগত তাদের ভূমি দখলের একটা ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায় অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অব আনপিপলিং অব ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাগ্রন্থে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ, এখন তা ৪৭ শতাংশ। তিন দশক ধরে ওই অঞ্চলে আদিবাসী কমছে আর বাঙালির সংখ্যা বাড়ছে। পাহাড়িরা হারিয়েছে ভূমি-বনাঞ্চল আর আমদানি করা সেটেলার বাঙালিরা দুর্বৃত্ত, আমলা, প্রশাসনের যোগসাজশে তা দখল করেছে।’
আবুল বারকাত তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, গত ৬৪ বছরে সমতলের ১০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ২ লাখ ২ হাজার ১৬৪ একর জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, যার দাম প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ফলে পাহাড় কিংবা সমতলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোকে অপর করে দেওয়ার এই রাজনীতির পেছনে মূল কারণ হচ্ছে ভূমি দখল। সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রভাবশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী– সবাই পাল্লা দিয়ে তা করে আসছে। রাষ্ট্রের তাতে পৃষ্ঠপোষকতা আর নীরব সমর্থন থাকছে।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
monoj.dey@prothomalo.com