আনিসুল হকের কলাম

শুধু দুর্নীতি-চুরি-লুট-পাচার বন্ধ করুন, মানুষ দেশকে সোনার দেশ বানাবে

আজ একটা নতুন দিন। আমাদের পুরোনো পঞ্জিকা সরিয়ে দেয়ালে নতুন পঞ্জিকা টাঙাতে হচ্ছে। জানুয়ারি ২০২৪-এর পাতা মেলে ধরা হয়েছে গেছে এরই মধ্যে। পুরোনোকে সরিয়ে আজ নতুনকে বরণ করার দিন। নতুন আশায় বুক বাঁধার দিন।

২০২৩ বেশ খারাপ গেল পৃথিবীর। গাজায় ২১ হাজারের বেশি মানুষ হত্যার শিকার হলেন, যার মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। হাসপাতালে, স্কুলে বোমাবর্ষণ চলল।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই রকম একটা গণহত্যা, শিশুহত্যা সভ্যতা থামাতে পারল না। যুদ্ধ এখনো চলছে। একটা সহজ সমাধান পৃথিবীর জ্ঞানীগুণী ক্ষমতাধরদের মাথায় আসছে না যে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি আসবে না।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামল না। থামবে—এই আশায় বুক বেঁধে আমরা বরণ করছি ২০২৪। কিন্তু থামবে যে, এই কথা জোর দিয়ে বলতে পারছি না।

সামনের দিনগুলোতে পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট বাড়বে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে সে রকমটাই পূর্বাভাস। চীনের অর্থনীতিতে নাকি ঝড় বইবে। তবে ভারত ভালো করবে, এ রকমই দেখলাম একটা অনলাইন পূর্বাভাসে (এইটিফাই)। তারা আরও বলছে, ভালো করবে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন।

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন আছে। তাতে রিপাবলিকানরা জয়লাভ করতে পারে। এতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের আশা আছে।

বাংলাদেশে আমরা কেমন থাকব? ২০২৩ আমাদের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ গেছে। বাসে-ট্রেনে আগুন, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম, ব্যাংক লুট, একপক্ষীয় নির্বাচনের দিকে যাত্রা—এর চেয়ে ২০২৪ সালের পক্ষে খারাপ হওয়া অসম্ভব। যা-ই হোক না কেন, ২০২৪ সালের বাংলাদেশ ২০২৩ সালের চেয়ে ভালো থাকবেই।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লড়াই সব সময়ই জারি রাখতে হয়, ২০২৪ সালেও সেই লড়াই চলবে। তবে জনজীবন আরেকটু শান্তিপূর্ণ, মানুষের চলাচল আরেকটু নিরাপদ হবে—এটা আমরা আশা করতে পারি। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশ থেকে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ‘রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ, ঋণ-কর-বিলখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং অবৈধ অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্তের’ হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে শাসক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে।

আমাদের দেশের প্রধান ভরসা হলো মানুষ। প্রবাসী শ্রমিকেরা, পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মূল্যবান রেমিট্যান্স আনেন দেশে। আর পাচারকারীরা, লুটেরারা সব ঝাঁঝরা করে ফেলে।

সিপিডির হিসাবমতে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ১৯টি ব্যাংকে ২৪টি বড় ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ৯২ হাজার কোটিরও বেশি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।

২০০৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায়।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি।

দেশে নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হলে সেই নির্বাচন ঠেকানো যায় না, এরশাদের আমলেও যায়নি। সেই সাধারণ সূত্র ধরে এবং এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হয়ে যাবে এবং আওয়ামী লীগই ক্ষমতা ধরে রাখবে।

সে ক্ষেত্রে তাদের দুর্নীতি, ঋণ-কর-বিলখেলাপি, পাচারের বিরুদ্ধে ইশতেহারের অঙ্গীকার তাঁদেরই বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। এবার কি এ কাজ সত্যি সত্যি করা যায়? চুরি রোধ করা যায়? ব্যাংক লুটপাট থামানো যায়? লুটপাটের টাকা ব্যাংকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়? পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া যায়?

দেশের মানুষ কী ভয়াবহ পরিশ্রমই না করছেন! তাঁরা কি আরেকটু সুশাসন পেতে পারেন না! যা চলছে, তা-ই কি তাঁদের প্রাপ্য ছিল! এ-ই কি তাঁদের বিধিলিপি!

মাস্টারকার্ড ইকোনমিক ইনস্টিটিউট বলছে, বাংলাদেশ ২০২৪ সালে হবে পৃথিবীর দ্বিতীয় দ্রুততম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ (৬.৩%)। ভারতের পরেই থাকবে তার অবস্থান। এডিবির পূর্বাভাস, জিডিপি হবে ৬ দশমিক ৫। অর্থমন্ত্রীর আশা ৭ দশমিক ৫।

একটা কথা ঠিক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচন সামনে রেখে ‘দেখি না কী হয়’ নীতি নিয়ে চলছে। অনেকেই নতুন ব্যবসার উদ্যোগ নিচ্ছেন না, মার্কেটিংয়ে অর্থ বরাদ্দ স্থগিত করে রেখেছেন। নির্বাচন হয়ে গেলে দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চাঙা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এখনকার তুলনায় ভালো হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্র নতুন নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, সরকারের লোকজনই নানা সময়ে তা বলেছেন। সে নিষেধাজ্ঞা হয়তো ভিসা নীতির মতোই কিছু হতে পারে। তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হলে ভুক্তভোগী জনগণই নতুন দুর্ভোগের শিকার হবে, তাতে শাসকদের ভাবান্তর ঘটবে না, সেটা নিশ্চয়ই স্যাংশনদাতারা বুঝবে।

কী দিচ্ছি কৃষক-শ্রমিক-প্রবাসীদের? ১০০ ডলার আসে, ৮০ ডলার পাচার করে দেয় ভদ্রলোকেরা! শুধু দুর্নীতি-চুরি-লুট-পাচার বন্ধ করুন। দেশের মানুষ দেশকে সোনার দেশ বানাবে। সে জন্য চাই জবাবদিহি। সে জন্য চাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সে জন্যে চাই আইনের শাসন। আর সবকিছুর মূলে গণতন্ত্র।

আশার একটা জায়গা বিভিন্ন দেশের পর্যবেক্ষকেরা দেখছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান-আবিষ্কারে। টিউমারের চিকিৎসা বের হতে পারে। চিকিৎসায় নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের জীবনকে সহজ ও সুন্দর করবে। এআই হবে সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। গুগল ও মেটার একাধিপত্যের বিপরীতে নতুন উদ্যোগ আসতে পারে। অস্ট্রেলিয়া নিউজ মিডিয়া বারগেইনিং কোড প্রবর্তন করেছে, যা এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্রতার বিপরীতে মানুষকে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নাজিম হিকমতের কবিতা ‘জেলখানার চিঠি’তে আছে: ‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষকে পৌঁছে দেবে মানুষ’। মানুষই একমাত্র আশার জায়গা, ভরসার জায়গা। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না, কারণ কৃষকেরা ফসল ফলাবেন। ডলার-সংকটের মুক্তিও ওই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মধ্যেই নিহিত। গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা যে এত কষ্ট করে নিজেদের উজাড় করে দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে চলেছেন, বিনিময়ে আমরা কী দিচ্ছি তাঁদের?

কী দিচ্ছি কৃষক-শ্রমিক-প্রবাসীদের? ১০০ ডলার আসে, ৮০ ডলার পাচার করে দেয় ভদ্রলোকেরা! শুধু দুর্নীতি-চুরি-লুট-পাচার বন্ধ করুন। দেশের মানুষ দেশকে সোনার দেশ বানাবে। সে জন্য চাই জবাবদিহি। সে জন্য চাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সে জন্যে চাই আইনের শাসন। আর সবকিছুর মূলে গণতন্ত্র।

২০২৪ নিয়ে তাই আশা ও আশঙ্কা দুই-ই আছে। আশা করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কী পথই-বা খোলা আছে! নাজিম হিকমতের ভাষায়:

বাতাস আসে, বাতাস যায়
চেরির একই ডাল একই ঝড়ে
দুবার দোলে না।
গাছে গাছে পাখির কাকলি
পাখাগুলো উড়তে চায়।
জানলা বন্ধ:
টান মেরে খুলতে হবে।
আমি তোমাকে চাই; তোমার মতো রমণীয় হোক জীবন
আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তমার মত...।।
আমি জানি, দুঃখের ডালি
আজও উজাড় হয়নি
কিন্তু একদিন হবে।।

জানালা বন্ধ, টান মেরে খুলতে হবে। দুঃখের ডালি আজও উজাড় হয়নি, কিন্তু একদিন হবে। হবেই। দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে। যে সমুদ্র সবচেয়ে সুন্দর, তা আজও আমরা দেখিনি। কিন্তু একদিন দেখব। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর শিশু আজও বেড়ে ওঠেনি। কিন্তু একদিন উঠবে। মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই, তা আজও বলিনি। কিন্তু নিশ্চয়ই একদিন বলতে পারব।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক