১০০ দিন পার হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা, সক্ষমতা বা দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনের স্থবিরতা, অর্থনীতির পরিস্থিতি, উপদেষ্টাদের যোগ্যতা-দক্ষতা—এসবই আলোচনার মূল বিষয়।
এই সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করে না, সেই অর্থে এই সরকার অরাজনৈতিক। কিন্তু একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের ফসল এই সরকারের পেছনের মূল শক্তিটি রাজনৈতিক; যারা গণ-অভ্যুত্থানের সংগঠক, সহায়ক ও সমর্থক হিসেবে কাজ করেছে।
সরকারের ১০০ দিন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু রাজনীতির মাঠে কী হচ্ছে? গণ-অভ্যুত্থান নতুন রাজনীতির যে সম্ভাবনা ও আশার আলো জ্বালিয়েছিল, সেই রাজনীতির মাঠে তো এখন আলোর স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে। মাঠে পানি-কাদাও জমতে শুরু করেছে। সেখানে অনৈক্য, সন্দেহ, অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তিই দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
কারা আছে রাজনীতির মাঠে? গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তাদের সহযোগী সংগঠন। রাজনীতির মাঠে তারা নতুন, কিন্তু সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি। রাজনৈতিকভাবে তারা কী করতে চায়, কতটুকু যেতে চায়, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
আছে আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর ক্ষমতাপ্রত্যাশী প্রধান দল বিএনপি। তারা বড় দল, আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে ১৬ বছর ধরে তারা মাঠে লড়াই-সংগ্রাম করেছে, নিপীড়ন ও জুলুমের শিকার হয়েছে। আছে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থী, ডান-বাম ও মধ্যপন্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এরা সবাই গণ-অভ্যুত্থানের সহায়ক শক্তি এবং সবাই কমবেশি আওয়ামী শাসনের নিপীড়নের শিকার।
পতিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে এই মাঠে দেখা যাবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এখন গোপনে তারা কিছু করছে না বা সামনে করবে না। তাদের আছে অর্থের জোর, লুটপাট করে লাখ কোটি টাকা সরিয়েছে তারা। এর বাইরে আছে নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী, ভাবুক ও চিন্তাবিদ গোষ্ঠী। সভা, সেমিনার, ওয়েবিনার, ফেসবুক বা ইউটিউবের মাধ্যমে তাঁরা রাজনীতির মাঠে হাজির থাকছেন।
বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠের পরিস্থিতি ভালো নয়। আগেই বলেছি, এখানে আলো কমতে শুরু করেছে। মাঠে শুধু পানিই জমেনি, তা যথেষ্ট ঘোলা হয়েছে। এর সুযোগ নিতে পারে পতিত রাজনৈতিক শক্তি। আর রাজনীতিতে যখন পানি ঘোলা হয়, তখন অনেক অচেনা বা গোপন শক্তিও সক্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, ঘোলা পানিতে মাছ ধরাই তাদের জন্য সুবিধাজনক।
রাজনীতিতে এই পক্ষগুলো এখন কী করেছে বা কী ভাবছে? বোঝা যাচ্ছে, গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিগুলোর মধ্যে শুধু বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ নয়, কেউ কাউকে সম্ভবত এখন আর বিশ্বাসও করছে না। কিছু রাজনৈতিক দল এখন ‘ষড়যন্ত্র’ বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসতে শুরু করেছে।
ফ্যাসিবাদের হাতে আবার দেশ বা জাতিকে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে—এমন কথাও তাদের মুখে শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এখানে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে সাধারণভাবে পতিত স্বৈরাচারের প্রতিই ইঙ্গিত করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়া, সেখানে বসে তাঁর নানা তৎপরতা এবং বাংলাদেশের পরিবর্তনকে ভারতের মেনে না নেওয়া—এই বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুশ্চিন্তা আছে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারে মেয়াদ, নতুন ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্র ও নেতা-নেত্রীর মাইনাস তত্ত্ব নিয়ে উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা ও ভয় কাজ করছে। সম্ভবত সেই বাস্তবতায় দ্রুত নির্বাচনের দাবিও উঠতে শুরু করেছে। সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ড. ইউনূসের ভাষণে নির্বাচনের রূপরেখা না থাকায় বিএনপির আশাহত হওয়ার কথা বলেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মুখে গতকাল মঙ্গলবার বেশ স্পষ্ট করেই ষড়যন্ত্রের কথা শোনা গেল। তিনি বলেছেন, কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে।
রাজনীতির মাঠে এ বিষয় নিয়ে চরম কৌতূহল আছে যে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজের আকাঙ্ক্ষা কী? তাদের প্রতিনিধিরা সরকারে আছে, আবার তারা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। তারা সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ করতে চায় কি না, সে প্রশ্নও আছে।
বর্তমান সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেই ছাত্ররা নির্বাচনের দিকে যেত চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, অতীতে রাজনৈতিক সমঝোতার পরও ক্ষমতায় গিয়ে দলগুলো প্রতিশ্রুতি মেনে চলেনি। এক স্বৈরতন্ত্র বিদায়ের পর নতুন স্বৈরতন্ত্র জন্ম নিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধি তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম গত সোমবার বলেছেন, এই সরকার কেয়ারটেকার সরকার নয়, শুধু নির্বাচন দেওয়াই এই সরকারের কাজ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য বিভিন্ন কমিশন হয়েছে এবং সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। এ অবস্থান বিএনপি বা কিছু রাজনৈতিক দলের অবস্থানের সঙ্গে যায় না। মির্জা ফখরুল ইসলামের মুখে একই দিন শুনলাম, ‘ছাত্ররা চাইবে সবকিছু পরিবর্তন করতে, আমরা তো জানি কতটুকু পরিবর্তন করতে পারবে।’ তিনি মনে করেন, নির্বাচন দিলেই অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
শুধু নির্বাচন ইস্যুতে নয়, রাষ্ট্রপতিকে সরানো বা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারেও ছাত্রদের চাওয়া ও বিএনপির চাওয়া এক নয়। আবার ছাত্রদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য কতটা বজায় আছে, সে প্রশ্নও উঠেছে। ছাত্রদের মধ্যে ভিন্ন মত, পথ ও চিন্তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ইস্যুতে। সরকারের বাইরে থাকা ছাত্রনেতাদের মুখে সরকারের নেওয়া নানা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে দেখা যাচ্ছে।
সম্প্রতি নেওয়া উপদেষ্টাদের কারও কারও ব্যাপারে ছাত্রদের তরফে কড়া সমালোচনা শোনা গেছে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, উপদেষ্টাদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত কোথা থেকে হয়? ছাত্রদের কি সেখানে কোনো ভূমিকা আছে বা থাকে? যদি উপদেষ্টা পরিষদ সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তবে সেখানে তো ছাত্রদের প্রতিনিধি রয়েছেন। তাহলে নতুন উপদেষ্টা নিয়ে ছাত্রনেতাদের তরফে আপত্তি ওঠে কেন? ছাত্রদের মধ্যে কি সমন্বয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে? ছাত্রদের রাজনৈতিক পরামর্শ কারা দেন? সেখানে কি ভিন্ন ভিন্ন মত-পথের লোকজন আছেন?
দেশের রাজনীতিতে এখন আওয়ামী লীগের কোনো প্রকাশ্য সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। স্বৈরশাসন, ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া, গুম, খুন, সীমা ছাড়া দুর্নীতি ও জনগণকে নানাভাবে অপমান—এসবের পর যেভাবে দেশের মানুষ দলটিকে বিদায় করেছে, তাতে অনেকে আশা করেছিলেন, এবার হয়তো তাদের বোধোদয় হবে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনুশোচনা দেখা দেবে, দল নিয়ে তারা নতুন করে ভাববে। কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণই নেই। দলটি যে পথে ফিরে আসার চেষ্টা করবে, তা নিয়মতান্ত্রিক হবে বলে মনে হয় না। তারা রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার পথ ধরতে পারে। এ ধারণা যদি সত্যি হয়, তবে রাজনীতির মাঠ হয়ে উঠবে চরম বিপজ্জনক।
রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে বুদ্ধিজীবীদের কারও কারও মুখে এখন শোনা যাচ্ছে, ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে, পরাজিত হয়েছে। বোঝা যায়, তাঁদের আশাভঙ্গ হয়েছে। তাঁরা যা চেয়েছিলেন, তা হয়নি। হবে, এমন সম্ভাবনাও হয়তো দেখছেন না। আবার অনেকে হাল ছাড়তে চাইছেন না, তাঁরা নতুন করে কিছু শুরু করার আশায় নানা ফর্মুলা নিয়ে হাজির হচ্ছেন।
আবার বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের মধ্যে শুরু থেকেই হতাশ হয়ে বসে আছে—এমন একটি পক্ষও আছে। তারা পতিত স্বৈরাচারের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা বলে না বা বলতে পারে না, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার কবে ব্যর্থ হবে, সেই আশায় বুক বেঁধে বসে আছে। তারা শুনতে চায়, মানুষ বলতে শুরু করবে, আগেই তো ভালো ছিলাম।
আরেক পক্ষ আছে, যারা ইউটিউবে ভিডিও বানায়, কথা বলে। সেখানে এমন অনেক কথা ও বক্তব্য থাকে, যা একধরনের জন-উসকানি তৈরি করে। অথবা এ উদ্দেশ্য নিয়েই এগুলো বানানো হয়। তাদের কোনো না কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে অথবা কোনো রাজনৈতিক পক্ষের হয়েই হয়তো তারা কাজ করে। কিন্তু সেই রাজনৈতিক শক্তি বা পক্ষটি কী, তা বোঝা যায় না; বরং অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তিকর। সরকার, সরকারের সহায়ক শক্তি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে এর প্রভাব পড়ে। তারা কী বলে বা কী বলতে পারে—এসব নিয়ে সরকারের লোকজনকেও নাকি সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠের পরিস্থিতি ভালো নয়। আগেই বলেছি, এখানে আলো কমতে শুরু করেছে। মাঠে শুধু পানিই জমেনি, তা যথেষ্ট ঘোলা হয়েছে। এর সুযোগ নিতে পারে পতিত রাজনৈতিক শক্তি। আর রাজনীতিতে যখন পানি ঘোলা হয়, তখন অনেক অচেনা বা গোপন শক্তিও সক্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, ঘোলা পানিতে মাছ ধরাই তাদের জন্য সুবিধাজনক। তারেক জিয়া কি সেই ষড়যন্ত্রের কথাই বললেন? সত্যিই কি কোথাও কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ চলছে?
গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজ ও পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো কি এই বিপদ টের পাচ্ছে? তারা কি বুঝতে পারছে এই পক্ষগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐক্য ও সমঝোতা কতটা জরুরি?
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
akmzakaria@gmail.com