মুমিন ব্যক্তি কখনো নীতি–আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতি করতে পারেন না। তাকওয়া বা খোদাভীতি এবং আখিরাত বা পরকালে বিশ্বাস আমাদেরকে সব সময় দুর্নীতিসহ সব ধরনের অপরাধ থেকে বিরত রাখে। কারণ, দুনিয়ায় অপরাধের শাস্তি হোক বা না হোক, আখিরাতে সব অপরাধের বিচার হবে। দুনিয়ায় মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া গেলেও আখিরাতে আল্লাহর দরবারে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেদিন আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘আজ আমি তাদের মুখ সিল করে দেব, তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’ (সুরা-৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ৬৫)। ‘জনপদের মানুষগুলো যদি ইমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দরজা খুলে দিতাম।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৯৬)
ইসলামে দুর্নীতিসহ সব অপরাধ দমনের মূল সূত্র হলো ‘হালাল ও হারাম’ তথা ‘বৈধ ও অবৈধ’ এবং ‘পবিত্র ও অপবিত্রতা’ মেনে চলা। কোরআন কারিমে বলা হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা কোরো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। যে সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব, এটি আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ২৯-৩০)। ‘হে মানুষ! পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৬৮)
দুর্নীতি মোকাবিলায় রাষ্ট্র ও প্রশাসনের বিভিন্ন পদে যোগ্য ও দক্ষ লোকদের নিযোগ দিতে হবে এবং মেধা, সততা ও কর্মনিষ্ঠার ভিত্তিতে পদায়ন ও পদোন্নতি দিতে হবে। হজরত ইউসুফ (আ.) মিসর সম্রাটকে বলেছিলেন, ‘আমাকে শস্যাগারের দায়িত্ব দিন, নিশ্চয় আমি এর হেফাজতকারী ও বিজ্ঞতাসম্পন্ন।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৫)। অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তিদের অসদুপায়ে চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান দুর্নীতির অন্যতম কারণ।
ন্যায়বিচার ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা দুর্নীতি প্রতিরোধের পূর্বশর্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের সাক্ষ্যদাতা হিসেবে আল্লাহর পথে দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান থাক। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা সুবিচার করো, এটা তাকওয়ার নিকটবর্তী, তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনকারীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ?’ অতঃপর তিনি খুতবায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তোমাদের আগের জাতিগুলোকে এ কাজই ধ্বংস করেছে, যখন তাদের কোনো বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে যখন কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তাকে শাস্তি প্রদান করত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদ (সা.)–এর কন্যা ফাতিমাও চুরি করত, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।’ (বুখারি: ৪২৬৩)
ইসলাম সব নাগরিককে সামাজিক দায়িত্ব দিয়েছে। সুতরাং দুর্নীতি ও অপরাধ দমনে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সামাজিক ও নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের আবির্ভূত করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে অন্যায় দেখবে সে যেন তা তার হাত দিয়ে বাধা দেয় আর যদি হাত দিয়ে বাধা না দিতে পারে, তবে যেন মুখ দিয়ে বাধা দেয়, আর যদি মুখ দিয়ে বাধা না দিতে পারে, তবে যেন অন্তর দিয়ে বাধা দেয়, আর এটি হলো দুর্বল ইমানের পরিচয়। (মুসলিম)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com