আমরা নিজেরা যখন কোনো ধারাবাহিক সামাজিক সমস্যার শিকার হই, বোধ করি তখনই আমরা সবচেয়ে নিবিড়ভাবে এর কার্যকারণ নিয়ে ভাবতে বসি। সেই ভাবনার ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে ব্যক্তি ‘আমি’ থেকে সামষ্টিক ‘আমরা’ হয়ে ওঠে প্রায়ই।
সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া যুগান্তকারী রাজনৈতিক ঘটনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা এবং একজন ব্যক্তি ও নারী হিসেবে মূল্যায়ন-অবমূল্যায়ন—সবই নতুন করে আমাদের চারপাশকে দেখার প্রয়োজন তৈরি করেছে। সে প্রয়োজন থেকেই এই লেখা।
মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুতগতির এবং পরিণাম-নির্ধারণী একটা সময় পার করছি আমরা। প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি আমাদের জীবনের সবখানে। সময়টাকে খানিকটা বলা যায় পৃথিবীর ইতিহাসে মানবপ্রজাতির নতুন যাত্রাপথে বয়ঃসন্ধিকাল। এমন এক অস্থির সময়ে, নতুন সম্ভাবনা ও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভয় ও যন্ত্রণার নতুন নতুন উপকরণ। এখানে শুধু একটা উপকরণ নিয়েই কথা বলব—সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে আরব বসন্তের যখন সূচনা হলো; তিউনিসিয়া, মিসর থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত ঘটে গেল যুগান্তকারী রাজনৈতিক পরিবর্তন, তার সূচনায় ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুকের বিশেষ ভূমিকা। দুনিয়ার নানা প্রান্তের মানুষকে একটা পাটাতনের ওপর দাঁড় করানোর এমন উপায় পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো আসেনি, যেভাবে এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হাত ধরে।
ফেসবুক এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থান–নির্বিশেষে একই জায়গায় এসে দাঁড়ায়। এখানে সব পেশা ও রুচির মানুষ এক হয়ে গেছে।
২০১০ সাল–পরবর্তী পৃথিবীর প্রায় সব বড় ঘটনায় ফেসবুকের ভূমিকা ছিল। তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত আমরা দেখলাম আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে। এখানে আমাদের তরুণদের নেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পতন হয়েছে। দেশের নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ সেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক সব মানুষকে এক উদ্দেশ্যে যুক্ত করে তুলেছিল, যা আন্দোলন সফল করায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আন্দোলনকালে আবেগ ও ধাক্কা থেকে বের হওয়ার পরপরই অনেকের রুচিহীন দিকটা আবার সামনে এসে উপস্থিত।
নৃতত্ত্ব পড়তে গিয়ে ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণ বিষয়ে যতটুকু এত দিনে আয়ত্ত করতে পেরেছি এবং একজন নারী হিসেবে সাধারণ যানবাহন কিংবা জনপরিসরে আমার ও আরও অসংখ্য নারীর যে অভিজ্ঞতা, তাতে বলা যায়, আমাদের এই ভূখণ্ডের একটা অংশের মানুষের ভেতর একধরনের ‘অবদমিত কামনার’ উপস্থিতি বিশেষভাবে বিদ্যমান। এর অবধারিত শিকার আমাদের নারীরা।
যেকোনো একজন নারী একটু পরিচিতি পেলে তাঁকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়, তা রীতিমতো ভয়ংকর। এ সময়ে ব্যাপকভাবে চর্চিত ভাইরাল সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ভিকটিম নারীরা। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে বিষয়টিকে ট্রাইবালিজম বা গোষ্ঠীতান্ত্রিকতা ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে বিবেচনা করা যায়।
মানুষের ইতিহাসের একটা পর্যায়ে যেমন অভিন্ন পেশা, জীবনযাপন পদ্ধতি ও সাংস্কৃতিক উপাদানের সমন্বয়ে একেকটা গোষ্ঠী তৈরি হতো, এখনকার সময়ে অনলাইন জগতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে রুচি, অভ্যাসকে কেন্দ্র করে অসংখ্য গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এটাকে ডিজিটাল ট্রাইবালিজম বলছেন।
ডিজিটাল মাধ্যম একটি দেশের বা সারা পৃথিবীর মানুষকে নানান উপলক্ষে একীভূত করার সুযোগ তৈরি করেছে। তৈরি হচ্ছে একেকটা গোষ্ঠী। সেখানে ভালো কাজের জন্য যেমন তৈরি হচ্ছে কোনো ‘পেজ’ বা ‘গ্রুপ’, তেমনি অবদমিত আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত মানুষগুলোও তৈরি করছে তাদের বলয়। সুযোগ মতো যে কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে তারা। কোনো রকম বাছবিচার না করে, বিবেক-বিবেচনাবোধ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তারা ‘ভাইরাল’ করছে কোনো খণ্ডিত সাক্ষাৎকার, কোনো অসতর্ক মুহূর্ত কিংবা শরীরী ভঙ্গি।
এই অন্যায্য কাজগুলো একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থার ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ দেখা যায় না এই মানুষগুলোর ভেতর। মিডিয়া কিংবা রাজনীতিতে সক্রিয় কিছু কিছু পুরুষও এমন অভিজ্ঞতা শিকার হন, তবে বিশেষত নারীদের প্রতি ‘ভাইরাল’ নির্যাতনে পাল্লাটা যেন বহুগুণ ভারী। এ প্রসঙ্গে আমি নিজের অভিজ্ঞতাকেই একটু কাটাছেঁড়া করে দেখাই।
সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থানে আমিও একটি অংশ হয়ে যাই মিডিয়ায় কাজ করার সুবাদে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি উপস্থাপনার কাজ করছি দেশের একটি শীর্ষ টেলিভিশন চ্যানেলে। সেখানেই আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আলোচনার সময় একজন অতিথির সঙ্গে অনভিপ্রেত ঘটনার সম্মুখীন হই। টেলিভিশন টকশোতে আলোচনার একপর্যায়ে সেই অতিথি আমার সঙ্গে এমন আচরণ করেন যেটা পেশাদার ছিল না। সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে আমার নাম এবং ওই অনুষ্ঠানের কিছু ক্লিপ।
গত আন্দোলনে যেসব পুরুষ অংশ নিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছেন, তাঁরা কিছুদিন পরই ফিরে যেতে পেরেছেন নিজের কাজে; কারণ, বয়স নিয়ে কেউ তাঁদের বিব্রতকর প্রশ্ন করে না। তাঁরা ছন্দে ফিরতে পারছেন; কারণ, তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্যের ওপর দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কাটাছেঁড়া অধিক স্থান পায়নি।
একজন পেশাদার সঞ্চালক হিসেবেই আমার আচরণ নির্ধারণ করেছি, খুব আলাদা কিছু করেছি বলেও মনে করি না। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের ‘ভাইরাল’ বিস্তারের পর প্রথমে এল আমার প্রশংসা এবং আন্দোলন শেষে শুরু হলো আমাকে নিয়ে নেটিজেনদের শত রকমের আগ্রহের অবাধ প্রকাশ।
কখনো কখনো তার কিছু কিছু আমি হয়তো উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ক্রমাগত আমি বুঝতে পেরেছি, কতটা নির্দয়ভাবে কেবল একজন নারী হওয়ায় আমাকে নানানভাবে হেনস্তার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার অনেক বছরের পুরোনো কোনো কনটেন্ট বা আধেয় এখন লাখো মানুষের মাইক্রোস্কোপের নিচে।
আমার কৈশোরকালের একটি সাক্ষাৎকার এখনকার কোনো ভিডিওর সঙ্গে মিশিয়ে আমার বয়স নিয়ে অযাচিত বিতর্ক তৈরি করা কিংবা আমার নামে বানোয়াট কোনো খবর তৈরি করা—কিছুই বাদ যাচ্ছে না।
ডিজিটাল ট্রাইবালিজমের এক নির্বিচার উপলক্ষ হয়ে গেল আমার জীবন, আমার ভালো-মন্দের দিকটি যেখানে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত।
আর এর মধ্য দিয়েই আমি আবার পর্যবেক্ষণ করলাম, আমাদের দেশে একজন পুরুষ যত সহজে তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে রাখতে পারেন, একজন নারী তা কখনোই পারেন না। সেটা পারিবারিকভাবে হোক কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে।
গত আন্দোলনে যেসব পুরুষ অংশ নিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছেন, তাঁরা কিছুদিন পরই ফিরে যেতে পেরেছেন নিজের কাজে; কারণ, বয়স নিয়ে কেউ তাঁদের বিব্রতকর প্রশ্ন করে না। তাঁরা ছন্দে ফিরতে পারছেন; কারণ, তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্যের ওপর দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কাটাছেঁড়া অধিক স্থান পায়নি।
নিজেদের কাজটা মন দিয়ে করতে পারছেন; কারণ, তাঁদের ছবি পাশে লাগিয়ে ‘লিংক আছে লিংক আছে’ বলে পৈশাচিক মিথ্যাচার ভয় দেখানো হয়নি। সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে আসা নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েও ‘কয় বাচ্চার মা’ দেখতে লাগে, তা নিয়ে করা বিকট আনন্দের বিষয়বস্তু হতে হয়নি। কী পোশাক পরা হলো, ওড়নার দৈর্ঘ্য কত, বসার স্টাইল কেমন—সেসব নিয়ে কোনো পুরুষকে কথা শুনতে হয় না। কিন্তু একজন নারী হিসেবে আমাকে এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এসব নিয়ে সামান্য প্রতিবাদও আমাকে ‘নারীবাদী’ ট্যাগে আরও হেনস্তা করার পথ খুলে নেবেন অনেক মানুষ।
তার ওপর অতীত পরিশ্রম আর কাজ সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনে কারও নিয়মিত কাজকেও ভাইরাল–পরবর্তী হাইপ ভেবে তাকে হালকা করে দেওয়া তো নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রে হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার উপস্থিতি বেশি সক্রিয় নয়। কারণ, এটা আমার কাজের ক্ষেত্র নয়। কিন্তু টেলিভিশনে কাজ করার সুবাদে কিংবা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করায় পেশাগত কারণেই আমার কাজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থাপিত হয়।
সেই কাজগুলোকে ‘ভাইরাল’ সংস্কৃতির অংশ হতে দেখে আমাদের সামগ্রিক বিচার-বিবেচনাবোধ নিয়ে যথেষ্ট বিব্রত বোধ করি। এসব ‘কনটেন্ট’-কে ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলতে না দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী আমি। তবে সবাই তো না–ও হতে পারেন। সেই মানুষটির জীবন নিশ্চয়ই অতিষ্ঠ হয়ে যায় আমাদের একটু মজা, লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের লোভে।
দেশ পরিবর্তন তো শুরু হলো; মানুষের পরিবর্তনের শুরু কোথায়?
দীপ্তি চৌধুরী নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী
ই–মেইল: diptychowdhury.bd@gmail.com