ঢাকায় কোথাও কোথাও গ্রাফিতি মুছে ফেলা হয় কিংবা গ্রাফিতির ওপর রং লেপে দেওয়া হয়।
ঢাকায় কোথাও কোথাও গ্রাফিতি মুছে ফেলা হয় কিংবা গ্রাফিতির ওপর রং লেপে দেওয়া হয়।

মতামত

অভ্যুত্থানের মালিকানা নিয়ে দাপট, কথা বলতে পারবে কি বিরোধীরা?

১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি রোজা লুক্সেমবার্গকে ডানপন্থী আততায়ীরা যখন মাথায় গুলি করে হত্যা করেছিল, তখন তাঁর বয়স ৪৭ বছর। মার্ক্সবাদী হলেও লেখক, দার্শনিক ও প্রবল যুদ্ধবিরোধী রাজনীতিবিদ রোজা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর সমালোচক। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের কারণে তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়েছে, শিকার হতে হয়েছে নির্যাতনের। যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজের জন্যই রোজা প্রাসঙ্গিক। কেননা অন্যের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে তিনি ছিলেন আপসহীন।

রোজা লুক্সেমবার্গ মনে করতেন, কেবল নিজের দলের সমর্থকদের জন্য যে স্বাধীনতা, সেটি আসলে কোনো স্বাধীনতাই নয়। স্বাধীনতা হচ্ছে সব সময়ের জন্য এবং বিশেষভাবে যাঁরা ভিন্নভাবে কথা বলেন, তাঁদের জন্য।

রোজার এই ভাষ্য ধরেই কবীর সুমন তাঁর বিখ্যাত গান ‘বিরোধীকে বলতে দাও’-এ গেয়েছেন—   ‘বিরোধীর যুক্তিটা বন্ধুরা আমল দাও/ বিরোধীর স্বাধীনতাটাই স্বাধীনতা সাব্যস্ত হোক।’ রোজার কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, একটা দেশ, একটা সমাজ কতটা গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, তা বোঝার একটা প্রধান মাপকাঠি হলো ভিন্নমতের মানুষেরা কতটা কথা বলার সুযোগ পান।

রোজা লুক্সেমবার্গ মনে করতেন, কেবল নিজের দলের সমর্থকদের জন্য যে স্বাধীনতা, সেটি আসলে কোনো স্বাধীনতাই নয়।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের ঔপনিবেশিকতা থেকে ২৪ বছরের মধ্যে দুবার স্বাধীনতা অর্জন করে এ ভূখণ্ডের মানুষ। ১৯৭১ সালে উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সামনে গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সে সম্ভাবনাকে আমাদের পূর্বসূরি নেতারা হেলায় হাতছাড়া করেছিলেন।

ব্রিটিশদের সেই ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতিকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভরকেন্দ্র করে তোলা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটা সমাজ গড়ে তোলার প্রবল যে সম্ভাবনা ও প্রচণ্ড শক্তি তৈরি হয়েছিল, বিভাজন হয়ে উঠেছিল তার জন্য ভয়াবহ এক আত্মঘাতী পরিণতি। অনিবার্যভাবেই যেটা ডেকে এনেছিল পঁচাত্তরের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিকতন্ত্রের দীর্ঘ প্রভাব। বিভাজনকে জিইয়ে রেখেই তারা শাসন চালিয়ে গেছেন।

দীর্ঘ আন্দোলনে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের দিকে যাত্রার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, আমাদের রাজনীতিবিদেরা সেই সুযোগ নষ্ট করেছিলেন। সেই সঙ্গে বিভাজনের রাজনীতির মধ্য দিয়ে সমাজকে ধীরে ধীরে মেরুকরণের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরে এই বিভাজন চূড়ান্ত মেরুকরণের দিকে চলে যায়। মেরুর দুই প্রান্তে অবস্থান করা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে বিরোধী দল যাতে ক্ষমতায় না আসতে পারে, সেই কৌশলই শুধু নেয়নি, বরং বিরোধীদের ঝাড়ে বংশে নিশ্চিহ্ন করার নীতি নিয়েছে। ফলে গণতন্ত্রের নামে এক ব্যক্তির শাসন থেকে আমাদের মুক্তি ঘটেনি।

বিভাজনের রাজনীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে অর্থনীতিতে। দুই দশক আগেও চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা সমানে-সমানে থাকলেও ভারতকে ছাড়িয়ে চীনের অনেক দূরে চলে যাওয়ার বড় কারণ হলো, চীনের সমাজে বড় কোনো বিভাজন নেই। সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অতি ডানপন্থী রাজনীতির উর্বর প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক সমাজ হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিরোধীদের, ভিন্নমতের মানুষদের কথা বলার স্বাধীনতা।

শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এক ব্যক্তির শাসন, স্বৈরতন্ত্র ও গোষ্ঠীভিত্তিক অর্থনীতি চূড়ান্ত রূপ নেয়। দুর্নীতি, লুটপাট, স্বৈরশাসন আড়াল করতে বিভাজনের রাজনীতি হয়ে উঠেছিল শেখ হাসিনা সরকারের প্রধান এক অস্ত্র। বিরোধী মতের কেউ কথা বলতে গেলে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ তকমা লাগিয়ে কোণঠাসা করা হতো।

একের পর এক গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আর গায়েবি মামলা দিয়ে ভিন্নমতকে দমন করা হতো। এ কাজে অবলীলায় সামরিক, বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্বিচারে ব্যবহার করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন এবং কয়েকটি ধারা সংশোধনের মধ্য দিয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিন্নমতকে দমন করার জন্য। ফেসবুকে পোস্ট ও লাইক দেওয়ার জন্য মামলা হয়েছে। বছরের পর বছর জেলে থাকতে হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হোক আর সাইবার নিরাপত্তা আইন হোক—দর্শনগত দিক থেকেই এই আইন নিবর্তনমূলক। এই আইনে মানহানিকে খুন, জখম, ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। হাসিনা আমলে এই দুই আইনে সংবাদকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা শিকার হয়েছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম ও সংজ্ঞায়ন নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব ল’-এর জ্যেষ্ঠ প্রভাষক সাইমুম রেজা বলেছেন, ‘“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন” না বলে “ডিজিটাল স্বাধীনতা আইন” বলা যেত। কারণ, আইনের শিরোনামে কোন শব্দ চয়ন করা হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি শুধু নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করব, নাকি নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সঙ্গে স্বাধীনতা নিয়েও ভাবব?’

সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়েও অংশীজনদের উদ্বেগ যায়নি। এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই আইনে খুলনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামে মামলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি করার অভিযোগেও মামলা হয়েছে। সমালোচনার পর আইন মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সাইবার আইনে দায়ের হওয়া স্পিচ অফেন্স–সম্পর্কিত (মুক্তমত প্রকাশের কারণে মামলা) মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া এসব মামলায় কেউ গ্রেপ্তার থাকলে তিনি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি পাবেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের নিবর্তনমূলক আইন যা বিরোধী মতকে শায়েস্তার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে, সেটা সংস্কার কিংবা বাতিল করতে কেন কমিটি করা হয়নি।

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ধরনের দিক থেকে স্বতঃস্ফূর্ত। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান সামাজিক বিভাজনকে মুছে দিয়ে নতুন একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী ও ক্ষমতার অংশীদার ছাড়া এই অভ্যুত্থানে কে অংশগ্রহণ করেনি? কার কী ধর্মপরিচয়, কার কী লিঙ্গ পরিচয়, কার কী জাতিপরিচয়—সব মুছে ফেলে সবাই মিছিল ও রাজপথের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

হাসিনার যে স্বৈরাচারী শাসন মানুষের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ছিল, তার পুলিশ ও দলীয় বাহিনী যখন ছাত্রদের বুকে গুলি চালিয়েছে, তখন ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম—সারা দেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে স্বজন হত্যার প্রতিবাদে অভূতপূর্ব এক সংহতি। এই অভ্যুত্থানে যে ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত হয়েছেন, যে ৩১ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন, তাতে ছাত্র, শ্রমিক, পথচারী, নারী, শিশু—কোন শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব নেই? ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় এবং পরে দেয়ালে দেয়ালে যে গ্রাফিতি আঁকা হয়, সেখানে সুস্পষ্টভাবে বিভাজনের বাংলাদেশকে পেছনে রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক এক সমাজের স্বপ্ন আঁকে আমাদের নতুন প্রজন্ম।

অথচ কেউ কেউ  ছাত্র-অভ্যুত্থানের মালিকানা প্রতিষ্ঠাতা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। শুরু থেকেই কেউ কেউ সেই পুরোনো কৌশলে সমাজে বিভাজন তৈরি করতে কোমর বেঁধে লেগেছেন। সারা দেশে শিক্ষার্থীরা দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে পারলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও বাধা দেওয়া হয়। ঢাকায় কোথাও কোথাও গ্রাফিতি মুছে ফেলা হয় কিংবা গ্রাফিতির ওপর রং লেপে দেওয়া হয়।

টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাজারে হামলা ও ভাঙচুর। রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্র সংস্কার কিংবা অর্থনীতি, বেকারত্ব, জিনিসপত্রের মূল্যস্ফীতি, কূটনৈতিক সম্পর্ক—এসব জরুরি প্রশ্নকে ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংস্কৃতিক লড়াইকে সামনে এনে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। সেই পুরোনো ধারায় যাকে-তাকে তকমা সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণার কারণে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করতে হয়েছে সরকারকে। এটা সরকারের জন্য একটা পিছু হটা।

বিভাজনের রাজনীতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে অর্থনীতিতে। দুই দশক আগেও চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা সমানে-সমানে থাকলেও ভারতকে ছাড়িয়ে চীনের অনেক দূরে চলে যাওয়ার বড় কারণ হলো, চীনের সমাজে বড় কোনো বিভাজন নেই। সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অতি ডানপন্থী রাজনীতির উর্বর প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক সমাজ হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিরোধীদের, ভিন্নমতের মানুষদের কথা বলার স্বাধীনতা। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান আমাদের সেই শিক্ষাটাকেই সামনে এনে দিয়েছে। আমরা যেন বিভাজনের রাজনীতিতে হারিয়ে গিয়ে সেই সম্ভাবনাকে হত্যা না করি।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী