ফাইরুজ অবন্তিকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন
ফাইরুজ অবন্তিকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন

মতামত

অবন্তিকারা কেন আত্মহত্যা করে

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী হয়েছে? সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক অপকর্মে বা অঘটনে কে বেশি আলোচনায় থাকবে তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন হলো, যৌন হয়রানি বা ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা কেন বারবার ঘটছে? শুধু তা-ই নয়, এখানে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে গেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও আরও বিশ্ববিদ্যালয়ের পর আলোচনায় এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

ফাইরুজ অবন্তিকা নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী শুক্রবার রাতে আত্মহত্যা করেছেন। মৃত্যুর আগে ২৪ বছর বয়সী এ তরুণী একটি সুইসাইড নোট লিখে গিয়েছেন। সেখানে তিনি তাঁর একজন ব্যাচমেট বা সহপাঠী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টরকে তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে গেছেন।

তিনি সুইসাইড নোটে লিখেছেন—‘আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না, কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইসিলাম!...এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।’

পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র—সবকিছুই তো এখন বিষাদগ্রস্ততা সরবরাহের পাইপলাইন। যার কারণে আদর্শবাদী রাজনীতি আত্মহত্যার জন্য যতটা না ব্যক্তিকে দায়ী করে, তার চেয়ে বেশি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের দিকেই আঙুল তোলে বেশি। এসবই কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিকে বাধ্য করে আত্মহত্যা করতে।

আত্মহত্যা অবশ্যই হত্যা। সেই হত্যা ব্যক্তি নিজেকে নিজেই করে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যার কারণে দেশের আইনে আত্মহত্যা একটি অপরাধ। আত্মহত্যাচেষ্টাকারীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ারও বিধান আছে। এর বাইরেও আত্মহত্যা কেন হত্যা, এ নিয়েও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে আলোচনা আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিষণ্নতা বা বিষাদগ্রস্ততাই হচ্ছে আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারণ। বিশ্বজুড়ে ২০–২৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণও আত্মহত্যা।

এখন এই বিষাদগ্রস্ততা কোনো কুকি বিস্কুট নয় যে যেটি কেউ খেয়ে ফেলল আর মরে গেল! পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র—সবকিছুই তো এখন বিষাদগ্রস্ততা সরবরাহের পাইপলাইন। যার কারণে আদর্শবাদী রাজনীতি আত্মহত্যার জন্য যতটা না ব্যক্তিকে দায়ী করে, তার চেয়ে বেশি পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের দিকেই আঙুল তোলে। এসবই কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিকে বাধ্য করে আত্মহত্যা করতে।

অবন্তিকার সুইসাইড নোট পড়ে যে কারও ধারণা হবে, তাঁকে আসলে আত্মহত্যা করতে বাধ্যই করা হয়েছে। এক সহপাঠীর নাম ধরে তিনি বলছেন, ‘আমার ক্লাসমেট ইভটিজারটা আমাকে এটাই বলছিল যে আমার জীবনের এমন অবস্থা করবে, যাতে আমি মরা ছাড়া কোনো গতি না পাই। তা-ও আমি ফাইট করার চেষ্টা করসি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সহ্য ক্ষমতার।’

ওই সহপাঠীর পক্ষ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী প্রক্টরও কী পরিমাণ তাঁকে ধারাবাহিক মানসিক নিপীড়ন চালিয়ে গেছেন, এমন অভিযোগ সুইসাইড নোটটিতে গুরুতরভাবেই আমরা দেখতে পাই। অবন্তিকার মায়েরও অভিযোগ বিচার না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন তাঁর মেয়ে।

মা তাহমিনা শবনম শুক্রবার রাতে আহাজারি করে বলছিলেন, ‘গত রোজায় সরকারি কলেজের অধ্যাপক স্বামীকে হারালাম। এবার মেয়েকে হারালাম। এক বছরের মধ্যে স্বামী ও মেয়ে আমার কাছ থেকে চলে গেল। মেয়ে আমার বিচারক হতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা তাকে বাঁচতে দিল না। ও সাহসী মেয়ে ছিল। বিচার না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।’

‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার বেলা সাড়ে তিনটায়।

অবন্তিকার আত্মহত্যার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই ঘটনার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। যার প্রেক্ষিতে আইন বিভাগের ওই সহপাঠীকে সাময়িক বহিষ্কার ও দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ এবং অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে সহায়তাকারী শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত ও প্রক্টরিয়াল বডি থেকে তাৎক্ষণিক অব্যাহতি প্রদান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুইসাইড নোটে এমনটিও ইঙ্গিত উল্লেখ আছে, অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতা ছিলেন।

দেশের আইনে, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দান করা একটি অপরাধ। আইনে এ-ও বলা আছে, আত্মহত্যাকারীর মৃত্যুর আগে রেখে যাওয়া সুইসাইড নোট প্ররোচনা দানকারীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। তবে সুইসাইড নোটের সমর্থনে আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।

অবন্তিকার সুইসাইড নোট তাঁকে আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী হিসেবে দুজনকে হাজির করছে। যদিও সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, ওই সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর এরই মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। নিজেদের দাবির সপক্ষে তথ্যপ্রমাণও দিয়েছেন। তাঁরা অবন্তিকার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগও এনেছেন।

সহকারী প্রক্টর বলছেন, এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য তিনি প্রস্তুত আছেন।

আবার এটিও মাথায় রাখতে হবে, এ দেশে ভুক্তভোগী নারীর ‘ভিকটিম ব্লেমিং’-এর শিকার হওয়াটাও নতুন না। অভিযুক্তরা ও তাঁদের পক্ষে অনেকেই সেই ভিকটিম ব্লেমিংয়ে নেমে যান।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নিয়েছে। একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি শনিবার দিনেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। অবন্তিকার মায়ের করা একটি মামলায় রাতে সেই সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টরকে পুলিশ আটক করেছে।

আশা করি, অবন্তিকার আত্মহত্যার জন্য কে কতটা দায়ী বা কেউ দায়ী কী না তদন্তেই সেটি বেরিয়ে আসবে। অবন্তিকার আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি নানা বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আশা করি তদন্তে সব দিক খতিয়ে দেখে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।

অবন্তিকার আত্মহত্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা হচ্ছে প্রক্টর অফিসে শিক্ষার্থীদের হয়রানি।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকায় ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রক্টর অফিসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীসহ অন্যদের শারীরিক ও মানসিক হয়রানির বিস্তর অভিযোগ আছে।

শিক্ষার্থীদের মাদক অভিযানের নামে হয়রানি, রাজনৈতিক কারণে হয়রানি, সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়েকে একসঙ্গে দেখলে ডেকে নিয়ে বিয়ে দিতে চাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানসিকভাবে হেয় করত প্রক্টর অফিস। এ ছাড়া রিকশাচালকসহ ক্যাম্পাসের বাইরের লোকজনকেও শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগও দেখা যাচ্ছে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের কাজ কী বা সেখানে কাজ করা প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরদের দায়িত্ব কী?

এককথায় বলতে গেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ শিক্ষার্থীসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তি, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সহায়তা ইত্যাদি প্রক্টর অফিসের কাজ বা প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরদের দায়িত্ব।

কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রক্টর অফিসকে আমরা কখনো শিক্ষার্থীবান্ধব হতে দেখি? প্রক্টর অফিসে কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে কোনো কিছু শোনার আগে একটি বাক্যই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শোনা যায়—আগে লিখিত অভিযোগ দেন। সেই লিখিত অভিযোগ চাওয়া প্রক্টর অফিসের বিরুদ্ধেই অভিযোগের পাহাড় জমে যেতে দেখি আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে, বিক্ষোভ-আন্দোলনের বিরুদ্ধেও কি ‘সদা প্রস্তুত’ থাকতে দেখা যায় না প্রক্টর অফিসকে?

অবন্তিকার সুইসাইড নোটে যে অভিযোগ, তাতে সে রকম একটা প্রক্টর অফিসের নমুনাই আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত তারেক হাসান নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রক্টর অফিস থেকে বারবার হ্যারেজমেন্টের শিকার হচ্ছেন বলেছিলেন আপু। ক্যাম্পাসে ফিরে এবার উপাচার্যের কাছে আবেদন করবেন বলেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে যায়।’

পরিবার, স্বজন, বন্ধুবান্ধুব, সহপাঠীদের ভাষ্যে জানা যাচ্ছে, প্রাণবন্ত তারুণ্যের একটা মানুষ ছিলেন ফাইরুজ। ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আত্মবিশ্বাসী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর-বাইরে সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজে ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থাপনা করতেন হাসিমুখে। ক্যাম্পাসের কুকুর-বিড়ালদের খাবার দিতেন, সেগুলো বিপদে পড়লে উদ্ধার করতেন।

তাঁর ফেসবুক আইডি ঘাঁটলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন অসহায় মানুষের প্রতি, সুবিধাবঞ্চিত শিশুর প্রতি সহানুভূতিশীল। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে অনেক ঘোরাঘুরিও করতেন তিনি। নিজেকে ও নিজের চারদিকে ঘিরে থাকা মানুষকে কতটা ভালোবাসতেন, সেটিই ইঙ্গিত দেয় তাঁর সুইসাইড নোটটি।

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে মেন্টাল হ্যারাজমেন্ট (মানসিক নিপীড়ন) নিয়ে কাজ করেছিলেন ফাইরুজ। কদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে আত্মহত্যা প্রতিরোধেও বার্তা দিয়েছিলেন। অবন্তিকারা তো এ রকমই হবেন। জীবনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবেন, অন্যদেরও মধ্যেও সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে দেবেন। কিন্তু এমন প্রাণোচ্ছল মেয়েটিই আত্মহননের পথ বেছে নিলেন, এটি কী করে মেনে নিই আমরা?  

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই-মেইল: rafsangalib1990@gmail.com