ঘটনাবহুল বছর ২০২২ বিদায় নিলেও শেষ হয়নি তার রেশ। ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম বিধ্বংসী সংঘাত ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, কোভিড–পরবর্তী পৃথিবীকে করে তুলেছে আরও বিপর্যস্ত। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের এক বছর পূর্ণ হলো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৯৪৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউরোপে যত সংঘাত হয়েছে, তার মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ সবচেয়ে বিধ্বংসী।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে রুশ সেনারা গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে প্রবেশ করে। ২০০৮ সালে ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য বানানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিলে রাশিয়া এ বিষয়টিতে তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে ধরে নেয় এবং এর পরিণতিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পথ ধরে।
পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় ইউক্রেন এই আক্রমণের অল্পবিস্তর প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলেও গত সেপ্টেম্বর মাসে গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে রাশিয়া ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলকে রাশিয়ার প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। পশ্চিমা দেশগুলোর আর্থিক ও সামরিক সহায়তার পাশাপাশি আফ্রিকা ও আরব অঞ্চলের ভাড়াটে সৈন্যদের অংশগ্রহণ ইউক্রেনের অবস্থানকে প্রথম থেকেই কিছু শক্তি জুগিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ভাড়া করা মিলিশিয়া, ওয়াগনার গ্রুপকে ব্যবহারের মাধ্যমে রাশিয়ান অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে তুলছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ মূলত বিশ্বে কর্তৃত্বপরায়ণতার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার একক কর্তৃত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টা করছে, অন্যদিকে ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করার বিবেচনা রাশিয়াকে কোণঠাসা অবস্থায় ফেলে দেয়। যার ফলাফল হিসেবে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করেন এবং তা ইউরোপের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করায় ইউরোপীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
বর্তমানে ইউক্রেনে চলছে শীতকাল, এ সময়ে মাটি বরফে ঢাকা ও স্যাঁতসেঁতে নরম থাকার কারণে ট্যাংকের মতো ভারী সামরিক যান চলাচল অসম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু মার্চের শুরুতেই ইউরোপে বসন্তকালের শুরু, তখন আবহাওয়া পাল্টাতে শুরু করবে এবং সে সময়ই রাশিয়া নতুন উদ্যমে তাদের ‘স্প্রিং অফেন্সিভ’ শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৫০ হাজার রুশ সৈন্যকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে। আরও প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার সৈন্যকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া বর্তমান শীতকালীন যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসেবে জ্বালানিকে অস্ত্রে পরিণত করার কৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছে। রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার পর ইউরোপীয় বিদ্যুৎ খাতে নেমে এসেছে বিপর্যয়। ইউক্রেনজুড়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অবকাঠামো ধ্বংস করে ইউক্রেনীয়দের মনোবল গুঁড়িয়ে দেওয়া এখন রাশিয়ার অন্যতম লক্ষ্য। ইউক্রেনে রাশিয়ার এই আক্রমণ সৃষ্টি করেছে দুর্বিষহ মানবিক বিপর্যয়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন হুমকি দিয়েছেন, নিজস্ব ভূখণ্ড রক্ষায় রাশিয়া প্রয়োজনে তার হাতে থাকা সব অস্ত্র ব্যবহার করবে। রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘ডার্টি বোমা’ ব্যবহারের অভিযোগ তুলে পাল্টা ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের হুমকি দিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ভয়াবহ পরিণতি হবে। এবং এই সতর্কবাণী আমেরিকার কাছ থেকে সরাসরি রাশিয়াকে দেওয়া হয়েছে।
তবে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে এই সতর্কবাণী কাজে আসবে কি না। কোনো কারণে যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী এই পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার হয়, তবে যুদ্ধের ধরন সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যাবে এবং সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি রোধ করা যাবে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া এই সংঘাত ইউক্রেনের ভেতরে সীমাবদ্ধ না থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্যান্য দেশ একটি বড় পরিসরে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইউরোপীয় কাউন্সিল রাশিয়ার সদস্য পদ বাতিল করেছে এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে রাশিয়ার ভেটো প্রদানের ক্ষমতা রদ করা হয়েছে।
কিন্তু এই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাশার চেয়েও অনেক ভালোভাবে সামলে নিয়েছে রাশিয়া। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার অর্থনীতি মাত্র ৩ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি সংকুচিত হয়েছে। আইএমএফ বলছে, ২০২৩ সালে রাশিয়ার অর্থনীতিতে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশের কাছাকাছি পুনরুদ্ধার ঘটবে। রাশিয়ার মতো বৃহত্তর শক্তির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থাগুলো সর্বোচ্চ ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবেই দেখা যায় যে নিষেধাজ্ঞার চাপ সহনশীল করার রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা রাশিয়ার আছে। সুতরাং রাশিয়াকে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য ভেঙে পড়লেও এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকার এবং আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে এর বাণিজ্য প্রসারিত হয়েছে।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে ইউক্রেনের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার ব্যাপক পরিসরের হামলাকে ‘ইউরোপের সম্মিলিত নিরাপত্তার প্রতি চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি এই যুদ্ধকে গোটা ইউরোপের যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে ট্যাংক সহায়তা দিচ্ছে। তবে ইউক্রেনের জেলেনস্কি ন্যাটোর কাছে শুধু ট্যাংক নয়, যুদ্ধবিমানও চাইছেন। এ ব্যাপারে অবশ্য এখনো কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের ধারণা রাশিয়া ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলগুলো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্য নিয়ে নতুন করে আক্রমণ শুরু করতে পারে। ইউক্রেন চাইছে তা প্রতিরোধ করার পাশাপাশি হারানো ভূমির পুনরুদ্ধার করতে।
বর্ষপূর্তিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিবিধি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে রাশিয়া এই যুদ্ধে নানা ধরনের কৌশল নিয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়া সাইবার কৌশলগুলোকে পুরোপুরি প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার নেওয়া কৌশল ইউক্রেন প্রতিরোধ করতে পারেনি। এ ছাড়া রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ওপর তারা কার্যকরভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। সার্বিকভাবে দেখা যায় যে প্রচলিত যুদ্ধ ছাড়াও হাইব্রিড যুদ্ধকৌশল, যেটা রণকৌশলে সাধারণভাবে গেরাসিমভ কৌশল হিসেবে পরিচিত, সেটার ব্যাপক প্রয়োগ করা হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে এবং বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র, যারা সবার সঙ্গে সমবন্ধুত্ব বজায় রাখে, তাদের জন্য এই ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সর্বজন গৃহীত আইনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার ওপর এই যুদ্ধ বড় হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা এখনো সম্ভব নয়। তবে এই যুদ্ধ বিশ্বরাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় নিরাপত্তাবলয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘ইউরোপীয়রা সর্বদা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখবে’—প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়কালে দেওয়া ফ্রান্সের এমন জোরালো বক্তব্য আজ হুমকির সম্মুখীন।
ইউরোপীয় নিরাপত্তা এখন অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। যা ইউরোপীয় নিরাপত্তাবলয়ের ভঙ্গুর চিত্রকেই তুলে ধরছে। রাশিয়া এই যুদ্ধ শুরু করলেও এর ভবিষ্যৎ অনেকটাই আমেরিকার ওপর নির্ভর করছে। কারণ, অনেকেই মনে করেন, এই যুদ্ধ এখন একটি প্রক্সি যুদ্ধে রূপ নিয়েছে।
আমেরিকা সরাসরি এই যুদ্ধ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ইউরোপ ও এশিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে মনে হয় এই যুদ্ধ হতে পারে একুশ শতকের অন্যতম দীর্ঘায়িত যুদ্ধ।
মেজর জেনারেল এ এন এম মুনীরুজ্জামান এনডিসি, পিএসসি, (অব.)। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। president@bipss.org.bd