যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবারে ভূমিধস বিজয় পেয়েছেন। দেশটির ইতিহাসে এ রকম বিজয় খুব বিরল। ট্রাম্প শুধু দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরেননি, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। বলা চলে এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ট্রাম্প তাঁর একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতাটা পেয়ে গেছেন।
এর ফলে যে ধরনের নীতিমালায় বিশ্বাস করে ট্রাম্প নির্বাচন করেছেন, সেটা বাস্তবায়ন করতে তাঁর কোনো ধরনের বাধা থাকছে না। ট্রাম্প প্রথমেই ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রথম’ নীতি বজায় রাখবেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ তিনি সর্বোপরি বজায় রাখবেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তিনি অভিবাসনের ওপর কড়াকড়ি নিয়মকানুন আরোপ করবেন। এমনও হতে পারে, যেসব অভিবাসীর কাগজপত্র ঠিক নেই, তাঁদেরকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে তিনি বাধ্য করবেন। এ ছাড়া মেক্সিকো বা অন্য কোনো সীমান্ত দিয়ে কোনো অভিবাসী যাতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারেন, তার জন্য কড়া বন্দোবস্ত করবেন।
এ ছাড়া জ্বালানি, পরিবেশ এবং কর নীতিমালায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেন। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি সম্পূর্ণ ট্রাম্পময় হবে।
বর্তমানে বিশ্বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ (বর্তমানে যেটা লেবাননে সম্প্রসারিত হয়েছে)—দুটি বড় সংঘাত চলছে। এ দুটি সংঘাত বন্ধ করবেন বলে ট্রাম্প আগেই ঘোষণা দিয়েছেন। তবে যুদ্ধ কীভাবে বন্ধ করবেন, সেই ধারণাটি তিনি তাঁর নীতিমালায় পরিষ্কার করেননি। ধারণা করা যাচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে একতরফাভাবে ইউক্রেনকে সমর্থন করে আসছে, সেখানে কিছুটা ঘাটতি পড়বে। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা কিছুটা অব্যাহত থাকলেও, আর্থিক সমর্থনে ভাটা পড়বে।
ট্রাম্প চাইবেন, ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে আর্থিক সহযোগিতা করুক। একটা ব্যাপারে অনেকে আশঙ্কার করছেন যে ট্রাম্প হয়তো বর্তমানে ইউক্রেনে ভূমিতে যেভাবে সামরিক অবস্থানগুলো আছে, সেটাকে বাস্তবে মেনে নিয়ে একধরনের শান্তিচুক্তি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করবেন। সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে, ইউক্রেনের দখলকৃত বেশ কিছু ভূমি রাশিয়ার হাতে চলে যাবে।
হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের ব্যাপারে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে সমর্থন এখন আছে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সেটা শুধু বজায় থাকবে না, আরও বাড়বে। আমরা ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দেখেছি, ইসরায়েলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। ট্রাম্প হয়তো হামাসকে একটা নির্দেশিত শান্তিচুক্তি করার জন্য চাপ বাড়াবেন। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ যাতে আরও ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা থাকবে।
ইরানের প্রতি ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিমালা খুবই কঠোর হতে পারে। ট্রাম্প সম্পূর্ণভাবে মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং শান্তি বিঘ্ন হওয়ার প্রধান কারণ হলো ইরান। ইরানের ওপর সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক—সব ধরনের চাপ নতুন করে আসবে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি ট্রাম্পের নীতির আলোকে নতুন করে সাজানো হতে পারে। ট্রাম্পের সময় স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তি, যেটা বর্তমানে কিছুটা স্তিমিত আছে, সেটা পুনর্জীবিত করা হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে ইসরায়েলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর পথ হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসনের দিক থেকে চাপ প্রয়োগ কিংবা উৎসাহিত করা হতে পারে।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্থিতিশীল সম্পর্ক রয়েছে, সেটা স্থিতিশীল থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ প্রভাববলয়ের ক্ষেত্রে একটা সম্প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এটি ভারতের জন্য অসুবিধার কারণ হবে। এখন ভারত অনেক জায়গাতেই তার প্রভাব নিয়ে খুব সহজভাবে প্রবেশ করতে পারে। ভবিষ্যতে হয়তো সেই সুবিধাটা তারা পাবে না। এর কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একটা শক্ত অবস্থান থাকবে।
প্রথম মেয়াদে চীনের ব্যাপারে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কঠোর। দ্বিতীয় মেয়াদে সেটা আরও বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনের ওপর নতুন চাপ বাড়াবেন ট্রাম্প। চীন থেকে রপ্তানি হয়ে আসা পণ্যের ওপর নতুন নতুন কর আরোপ করা হবে। বিশেষ করে, মার্কিন বাজারে ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল, সোলার উপকরণ, মোবাইল ফোন প্রযুক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন বড় বাধার মুখে পড়বে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একটা প্রযুক্তি যুদ্ধের পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
সামরিকভাবেও চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কঠোর নজরদারি করবে। বিশেষ করে চীন যাতে তাইওয়ানের ওপর কোনোভাবেই চাপ সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি থাকবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে তাইওয়ান যেন নিজেদের প্রতিরক্ষায় আরও দায়িত্ব নেয়। বর্তমানে তাইওয়ান তাদের বাজেটের ৩ শতাংশ প্রতিরক্ষায় ব্যয় করে। ট্রাম্প চাইবেন তাইওয়ান তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট যেন এখনকার চেয়ে অনেকটা বাড়ায়।
আঞ্চলিক কৌশলগত নীতিমালা যেমন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বে দিয়ে আসছে। ট্রাম্পের মেয়াদে সেটা অব্যাহত থাকবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বটা বাড়বে। বাইডেন প্রশাসনের সময় আমরা দেখেছি অকাস (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা জোট) আসার পরে কোয়াডের (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের নিরাপত্তা জোট) গুরুত্বটা আগের তুলনায় কমেছে। এর কারণ হলো অকাসে হার্ড সিকিউরিটি পাওয়ার বা সামরিক বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত। ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অপ্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থার চেয়ে প্রচলিত নিরাপত্তাব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়বে।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারত্ব আছে। চীনকে প্রতিহত করার কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব রয়েছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এ কৌশলে কোনো পরিবর্তন আসবে না, সেটা বজায় থাকবে।
ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, তবে এটিকে অনেক ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জিত করে দেখা হয়। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পরাশক্তির সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত আবেগ তেমন স্থান পায় না। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাস্তবতা বা রিয়েল পলিটিক। বাস্তবতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থে যা যা করার দরকার, সেগুলো মাথায় রেখেই এগোবে। এখানে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্থিতিশীল সম্পর্ক রয়েছে, সেটা স্থিতিশীল থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার ভবিষ্যৎ প্রভাববলয়ের ক্ষেত্রে একটা সম্প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এটি ভারতের জন্য অসুবিধার কারণ হবে। এখন ভারত অনেক জায়গাতেই তার প্রভাব নিয়ে খুব সহজভাবে প্রবেশ করতে পারে। ভবিষ্যতে হয়তো সেই সুবিধাটা তারা পাবে না। এর কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একটা শক্ত অবস্থান থাকবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটা সুসম্পর্ক আছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সেটা অব্যাহত থাকবে। এখানে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ আসবে না। একটা বিষয় আমাদের সবার মনে রাখতে হবে, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে তালিকা আছে, সেখানে অনেক দেশের স্থান বাংলাদেশের চেয়ে ওপরে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় বাংলাদেশ খুব বড় আকারে আসে না।
ভারতের অনেক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে অনেক কিছু অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে। ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।
ট্রাম্প জিতে যাওয়ায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর কোনো চাপ আসবে, এমন ধারণা ভিত্তিহীন ও অবাস্তব। অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশকে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরে আসুক। বাস্তবসম্মত সময়ের মধ্যে নির্বাচন ও গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে মত দিচ্ছেন, ট্রাম্প ফেরায় বাংলাদেশ বেকায়দায় পড়বে। এটা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ কেউ হয়তো তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের চাঙা করতে এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা উদ্ভট চিন্তা।
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ