মতামত

ইমরান খানের কারাদণ্ডের পর কোন পথে পাকিস্তানের নির্বাচন

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
ছবি : রয়টার্স

ইমরান খান দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তোষাখানা মামলায় ‘দুর্নীতিপ্রবণ কাজকারবার’ চালানোর দায়ে তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারি পদে তাঁকে অযোগ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই গোটা প্রক্রিয়াকে ক্ষমতাসীন পিএমএল-এন সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা নির্বাচনী ক্ষেত্র (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) প্রস্তুত করার অংশ বলে দাবি করেছে। সন্দেহ নেই, এ ধরনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কাজ চলতে থাকবে।

এক দশকের কিছু বেশি সময় আগে পিপিপির নেতা ইউসুফ রাজা গিলানি এবং পিএমএল-এনের নেতা নওয়াজ শরিফ একই কায়দায় সরকারি দপ্তর পরিচালনার অযোগ্য হয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতা ইমরান খান তৃতীয় ব্যক্তি, যিনি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কারণে নির্বাচনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা হারালেন।

গিলানি ও নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল; আর ইমরান খানকে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর গদি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ১৬ মাস পর ভোটের অযোগ্য ঘোষণা করা হলো। তাঁদের মধ্যে নওয়াজ ও ইমরানকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

২০১২ সালে গিলানি অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের ইতিহাস ফিরে আসা থেকে রেহাই পায়নি। যে ঘটনা ও প্রক্রিয়াগুলো প্রধানমন্ত্রিত্ব ও রাজনীতি থেকে নওয়াজ শরিফের অকাল-অপসারণ ত্বরান্বিত করেছিল, তা প্রত্যেকের স্মৃতিতে এখনো তাজা আছে। একবার ‘জবাবদিহি’ শব্দটার কথা ভাবুন, এরপর ভাবুন সফল ও জনপ্রিয় নেতাদের কথা, যাঁরা এমন একটি বিশেষ ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট, যে গোষ্ঠীর হাতে আসল ক্ষমতা রয়ে গেছে।

এ কারণে সবার চোখ এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেই দিকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান যদি রাজনীতিকদের মধ্য থেকে কেউ হন, তাহলে আন্দাজ করা যায়, নির্বাচন আগামী নভেম্বরই হবে। আর যদি আমলাদের মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক-প্রধান হন, তাহলে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে যেতে পারে।

লক্ষ্য করার বিষয় হলো, বেসামরিক যে নেতাই গদিতে বসেছেন, সেই নেতাই একটা পর্যায়ে গিয়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা শুরু করে দিয়েছেন; নিজের সাংবিধানিক কর্তৃত্বের ওপর ভরসা করা শুরু করে দিয়েছেন।

কিছু ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর পরিণতি ভোগ করার পরও তাঁরা মনে রাখতে চান না, কারা তাঁদের ক্ষমতারোহণের পথ প্রসারিত করে দিয়েছিল ও কারা তাঁদের ক্ষমতার মসনদে যাওয়াকে সহজ করে দিয়েছিল।

ইমরান খান অন্তর্বর্তীকালীন মুক্তি পান বা না পান (তাঁর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে শুনানি চলছে), তাতে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে বাকি রাজনীতিকদের কাছে দেওয়া বার্তার কোনো হেরফের হবে না; অর্থাৎ তিনি যদি উচ্চ আদালত থেকে খালাস পেয়েও যান বা আরও জনপ্রিয়তা পান, তাহলেও নেপথ্যের ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর কাছে তিনি আর আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারবেন না।

২০১৮ সালে আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর নওয়াজ শরিফের প্রতি জনসহানুভূতি বেড়েছিল। কিন্তু নেপথ্যের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী আগেই এই বার্তা দিয়েছিল যে পরবর্তী পার্লামেন্টে নওয়াজের গুরুত্ব তেমন নেই। ওই সময় পাঞ্জাব পরিষদে সবচেয়ে বড় দল ছিল পিএমএল-এন। তারপরও লাহোরে সরকার গঠনের সময় কী হয়েছিল, তা কে না জানে।

এই পটভূমিতে বেশির ভাগ পাকিস্তানির কাছে এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে?

আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নতুন নির্বাচিত সরকার আসার আগপর্যন্ত যাবতীয় নির্বাহী সিদ্ধান্ত দেবেন।

নিয়মানুযায়ী, জনমতের ভিত্তিতে কাউন্সিল অব কমন ইন্টারেস্টসের (সিসিআই) ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ অনুমোদনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। এর আগে শাসক জোটের সদস্য পিপিপি এবং এমকিউএম-পি উভয়েই সিসিআইএর সিদ্ধান্তের বিষয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল।

গত শুক্রবারও পিপিপির নেতারা বলেছিলেন, বিতর্কিত জনমত জরিপের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন করা বিপর্যয়কর হবে এবং তাঁরা এর তীব্র বিরোধিতা করবেন। কিন্তু শনিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিবৃতি অনুসারে ‘সর্বসম্মতভাবে’ তা অনুমোদিত হয়েছে।

সহজেই বোঝা যাচ্ছে, আক্ষরিক অর্থেই শুক্রবার দিবাগত সারা রাত ধরে কেউ না কেউ পিপিপি ও এমকিউএম-পির নেতাদের বুঝিয়েছেন, সর্বশেষ ভোটার তালিকা ধরে নির্বাচন হলে তাঁদের উভয় দল সিন্ধুতে পিটিআইয়ের হুমকি থেকে বেঁচে যাবে।

সর্বশেষ ভোটার তালিকা ধরে নির্বাচনের বিষয়ে পিএমএল-এনের আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, তাদের এটি বোঝানো হয়েছে, সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী ভোট হলে তা তাদের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির দাবি মেটাবে; অর্থাৎ ২০১৮ সালে পিএমএল-এন যেমন রাজনীতির কুটিল পাশার চক্করে বাদ পড়েছিল, বিদ্যমান জনশুমারিতে ভোট হলে তা ঠিক সেইভাবে পিপিপির ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ যেমনটা ঘোষণা দিয়েছেন, সেইমতো যদি আগামী বুধবার পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের হাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সর্বোচ্চ তিন মাস সময় থাকবে।

নির্বাচন কমিশন এই অবস্থান নিয়েছে যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তিন মাসের বেশি সময় লাগতে পারে; অর্থাৎ নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। আর যদি বিলম্বিত হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে, কতটা বিলম্বে হতে পারে?

এ কারণে সবার চোখ এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেই দিকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান যদি রাজনীতিকদের মধ্য থেকে কেউ হন, তাহলে আন্দাজ করা যায়, নির্বাচন আগামী নভেম্বরই হবে। আর যদি আমলাদের মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক-প্রধান হন, তাহলে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে যেতে পারে।

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

  • আব্বাস নাসির পাকিস্তানের সাংবাদিক ও লেখক এবং ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক