৩২ বছর ধরে হিজবুল্লাহর নেতা ছিলেন হাসান নাসরুল্লাহ। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন তিনি।
হিজবুল্লাহর দক্ষিণ ফ্রন্টের কমান্ডার আলী কারকি এবং অন্যান্য হিজবুল্লাহ কমান্ডারও বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠ দাহিয়েহতে ব্যাপক বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, মাত্র এক সপ্তাহ আগে বৈরুতে হিজবুল্লাহর সিনিয়র কমান্ডার ইব্রাহিম আকিলকেও হত্যা করে ইসরায়েল। ইরানে ইসরায়েলের হাতে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোপ্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার মাত্র দুই মাস পর এসব ঘটনা ঘটল।
এ মাসের শুরুতে লেবাননে নজিরবিহীন হামলায় হিজবুল্লাহ কমান্ডারদের পেজার ও অন্যান্য যোগাযোগ ডিভাইসগুলো বিস্ফোরণে অনেক নেতা মারা যান। সব মিলিয়ে এখন হিজবুল্লাহ একটি শূন্যতায় পড়েছে বলে মনে হয়।
ইসরায়েল এটিকে তাদের জন্য বিশাল বিজয় বলে দাবি করেছে। তবে পর্যবেক্ষকেরা শঙ্কা করছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষের মাত্রা বাড়বে।
তাহলে এরপর কী হবে?
নাসরুল্লাহ তখন হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে টেলিভিশনে বক্তৃতা দিয়েছেন। হিজবুল্লাহ সে সময় ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। সর্বশেষ ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর শেষ বক্তৃতায় পেজার হামলার বিষয়ে বক্তব্য দেন।
নাসরুল্লাহর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। ১৯৯২ সালে তিনি হিজবুল্লাহর মহাসচিব হন। তাঁর পূর্বসূরি আব্বাস আল-মুসাভি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা নিহত হয়েছিলেন।
হিজবুল্লাহ (আরবিতে আল্লাহর দল) ইরান-সমর্থিত দল। ১৯৮২ সালে দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এটি গড়ে ওঠে। এর বেশির ভাগ সমর্থক শিয়া মুসলমান।
ইসরায়েলের সঙ্গে এক যুদ্ধের পর নাসরুল্লাহর জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌঁছায়। বক্তৃতায় তিনি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উপাদানগুলো মিলিয়ে নিপুণভাবে তুলে ধরতেন।
সিরিয়ায় ২০১১ সালের বিদ্রোহ দমনে সহায়তা করার জন্য প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষে যোদ্ধা পাঠিয়েছিলেন নাসরুল্লাহ। এ জন্য কিছু বিশ্লেষক তাঁকে ইরানের মিত্র শিয়া দলের নেতা হিসেবেও সমালোচনা করেছেন।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হয়। নাসরুল্লাহ তখন হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে টেলিভিশনে বক্তৃতা দিয়েছেন। হিজবুল্লাহ সে সময় ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। সর্বশেষ ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর শেষ বক্তৃতায় পেজার হামলার বিষয়ে বক্তব্য দেন।
হিজবুল্লাহর সাত থেকে আট সদস্যের শুরা কাউন্সিল এখন দলের নেওয়া নির্বাচন করবে।
হাশেম সাফিউদ্দিন হিজবুল্লাহর বর্তমান নির্বাহী পরিষদের প্রধান। তিনি দলের সম্ভাব্য নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় থাকবেন।
কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রধান হিসেবে সাফিউদ্দিন হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করেন। তিনি জিহাদ কাউন্সিলেরও সদস্য। এই কাউন্সিল দলের সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। সম্পর্কে তিনি নাসরুল্লাহর মামাতো ভাই।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক পেজার আক্রমণের পর সাফিউদ্দিন বলেছেন, নতুন এই আক্রমণের জন্য বিশেষ শাস্তি দেওয়া হবে ইসরায়েলকে।
গতকাল শনিবার একটি বিবৃতিতে নাসরুল্লাহর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে হিজবুল্লাহ। তারা বলেছে, গাজার সমর্থনে ও লেবাননের প্রতিরক্ষায় সামরিক অভিযান চালিয়ে যাবে।
আল–জাজিরার সংবাদদাতা ইমরান খান লেবাননের মারজায়ুন থেকে জানান, নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার সংবাদ প্রকাশের পর হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরায়েলে পাঁচটি রকেট হামলা চালায়।
নাসরুল্লাহর মৃত্যুতে হিজবুল্লাহ সাময়িক ধাক্কা খেলেও দীর্ঘ মেয়াদে থমকে যাবে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটি দীর্ঘ মেয়াদে তেমন বাজেভাবে প্রভাবিত হবে না। কারণ, হিজবুল্লাহ একজন নেতার বদলে অন্য নেতার নেতৃত্বে পরিচালিত হতে অভ্যস্ত। তাদের বিশাল সামরিক অস্ত্রাগার ও শক্তি এখনো অটুট।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মারান্দি বলেন, বৈরুতকে হিজবুল্লাহর ‘দুর্বলতম জায়গা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, লেবাননে পশ্চিমা দূতাবাস এবং পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা অবস্থান করেন। তবে সামগ্রিকভাবে ভাবলে ‘ইসরায়েলের সামর্থ্য নেই হিজবুল্লাহকে সামরিকভাবে পরাস্ত করার’।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটি এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, এমন নয়; তারা বরং অস্থায়ী নেতৃত্বের শূন্যতার মধ্যে কাকে বেছে নেবে, সেটাই প্রশ্ন।
‘হিজবুল্লাহ নেই হয়ে যাচ্ছে না,’ বলেছেন কার্নেগি মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো ইয়েজিদ সায়িগ। ইরান এখন তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে না এলেও হিজবুল্লাহ এখন ‘কৌশলগত ধৈর্য ধারণ’ করবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হিজবুল্লাহ একটা ভুল করে ইসরায়েলের তুলনায় নিজেকে দুর্বল করে ফেলেছে। হামাদ বিন খলিফা ইউনিভার্সিটির পাবলিক পলিসির সিনিয়র অধ্যাপক সুলতান বারাকাত বলেছেন, হিজবুল্লাহ যে বড় ভুল করেছে, তা হলো ইরানিদের প্রক্সি হিসেবে নিজেদের অতিরিক্ত ব্যবহার করে ফেলা। যখন তারা লেবাননের ভূমিতে লেবাননের মানুষের মুক্তির জন্য লড়ছিল, তখন তারা বেশি কার্যকর ছিল।
হামলার আগে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তাঁর প্রধান বার্তা ছিল, ‘আমরা জয়ী হচ্ছি।’ ইসরায়েল হিজবুল্লাহর ওপর এই ধ্বংসাত্মক হামলাকে বড় বিজয় বলে দাবি করছে।
বিশেষজ্ঞরা অনেকাংশে একমত, ইসরায়েল আক্রমণ অব্যাহত রাখবে। তাঁরা হিজবুল্লাহর এই সাময়িক নেতৃত্ব–শূন্যতার সর্বোচ্চ সুযোগ নিতে চাইবে।
যে ইসরায়েলিরা নেতানিয়াহুর বিরোধিতা করছিল, তারা আসলে গাজায় তাঁর ব্যর্থতার বিরোধিতা করেছিল। তারা যুদ্ধবিরোধী জনতা ছিল না।
তবে ইসরায়েল তাদের কথিত প্রতিরোধ নির্মূল এবং পরিস্থিতি শান্ত করবার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। অতীতেও আক্রমণ যত তীব্র হয়েছে, প্রতিরোধও তত বেড়েছে। এবার তার ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ নেই।
ইসরায়েলের আক্রমণ অব্যাহত রাখতে হলে মার্কিন গোলাবারুদ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘটনার পর নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ডকে হিজবুল্লাহর হাতে শত শত মার্কিন হত্যার পাল্টা ‘ন্যায়বিচার’ বলে উল্লেখ করেছেন।
নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ড ইরানের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়ার শঙ্কা বাড়িয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আর এই অঞ্চলে যুদ্ধের মাত্রা বাড়ানোর মধ্যে আরও সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখবে।
নিরাপত্তাবিশ্লেষক আলী রিজক আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান সম্ভবত সর্বাত্মক আক্রমণের পথ বেছে নেবে না।’ দেশটি সম্ভবত ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সরাসরি সংঘর্ষে প্রবেশের আগে ইরাক ও ইয়েমেনে তার মিত্রদের মাধ্যমে যুদ্ধগুলো অব্যাহত রাখবে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান শনিবার নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিবৃতিতে জানান, এ হত্যাকাণ্ড ‘প্রতিরোধকে আরও শক্তিশালী করবে’।
মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভুলে যাবে না যে এই ‘সন্ত্রাসী হামলার’ আদেশ নিউইয়র্ক থেকে জারি করা হয়েছিল। তিনি সম্ভবত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নেতানিয়াহুর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেই এ কথা বলেছেন।
আল জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন