মতামত

‘মধ্য আয়ের ফাঁদ’ থেকে বাঁচতে হলে...

বাংলাদেশকে ২০৩১ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে এবং পরবর্তী সময়ে ২০৪১ সালে একটি উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তর করতে হবে। এই লক্ষ্য নিয়ে সরকার এগোচ্ছে।

লক্ষ্য দুটি অর্জন বাংলাদেশের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। তার কারণ হলো, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো ‘মধ্য আয়ের ফাঁদে’ পড়ার ঝুঁকির আশঙ্কাও বাংলাদেশের রয়েছে।

এই ফাঁদ এড়াতে, বাংলাদেশকে অবশ্যই দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো সফল দেশগুলোর অর্থনৈতিক কৌশলগুলো অনুকরণ করতে হবে। তারা সব সেক্টরে ব্যাপক সংস্কার ও বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত উন্নয়ন করেছে।

বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ২০২৩ সালে ২ হাজার ৫২৮ মার্কিন ডলার ছিল। আর সেটি বৃদ্ধি করে একটি উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের জন্য জাতিসংঘ দ্বারা নির্ধারিত ন্যূনতম ১২ হাজার ৫০০ ডলারে পৌঁছাতে হবে।

অন্যদিকে ২০২৩ সালে অর্জিত ৬ শতাংশ জিডিপি হারকে বাড়াতে হবে কমপক্ষে ৮ শতাংশে। এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা লাগবে। তাই এটি কার্যকরের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমাদের এখনই নিতে হবে। আমাদের অবশ্যই একটি কার্যকর আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং সমাজে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এলডিসি থেকে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনে কিছু মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম (জিএনআই), হিউম্যান অ্যাসেট ইনডেক্স (এইচএআই) এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দুর্বলতা সূচক (ইভিআই)।

এই সূচকগুলো আয়ের স্তর, মানবসম্পদ এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে অভিযোজন যোগ্যতা মূল্যায়ন করে।

বর্তমানে চাকরির প্রায় ৬২ শতাংশ কম উৎপাদনশীল সেক্টরে কেন্দ্রীভূত, যেখানে প্রধানত অদক্ষ শ্রমিক ও কৃষিকর্মীরা কাজ করছেন। আধা দক্ষ কর্মজীবীর অবস্থান, যেমন কেরানি, পরিষেবাকর্মী, প্ল্যান্ট ও মেশিন অপারেটর এবং অ্যাসেম্বলার মোট চাকরির ৩৩ শতাংশ।

পক্ষান্তরে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পদ, যেমন নির্বাহী, সরকারি কর্মচারী, পেশাদার ও সহযোগী পেশাদার মোট চাকরির মাত্র ৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে।

শ্রমিকদের রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তির একটি প্রধান ভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে যা জিডিপি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। শুধু ২০২৩ সালেই রেমিট্যান্স হিসেবে প্রায় ২১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার এসেছে।

বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী বিশ্বজুড়ে কর্মরত এবং বার্ষিক গড়ে শূন্য দশমিক ৩ থেকে শূন্য দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষ অভিবাসন গ্রহণ করছে। এ ক্ষেত্রেও ৫৭ শতাংশ অদক্ষ শ্রমিক। মাত্র শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ পেশাজীবী এবং ৩৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত।

কাজেই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও অভিবাসন—উভয় ক্ষেত্রেই প্রধানত স্বল্প দক্ষ কর্মী বাহিনী কাজে নিয়োজিত। ফলে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনে তিনটি মানদণ্ড পূরণ করা কঠিন হবে। এসব চ্যালেঞ্জকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই শিক্ষিত ও উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তি তৈরির উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যার লক্ষ্য হবে উৎপাদনশীলতা ও জিডিপির হার বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা।

একটি শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যুগের বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

আমরা অটোমেশন, প্রযুক্তিনির্ভর সার্ভিস এবং অনিশ্চিত কাজের ল্যান্ডস্কেপের যুগে আছি। এই পরিস্থিতিতে ক্রিটিক্যাল থিংকিং, সৃজনশীলতা, লাইফ লং লার্নিং এবং উদ্ভাবন দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তির প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে, তাদের গ্র্যাজুয়েটরা যেন আজকের পরিবর্তনশীল কর্মসংস্থানের ল্যান্ডস্কেপে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেন। এ ধরনের গ্র্যাজুয়েটরা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অভিযোজনযোগ্যতাকে চালিত করবেন।

যদিও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিতে জ্ঞান প্রদানে উৎকর্ষ সাধন করেছে। তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি কর্মসংস্থানযোগ্য (জেনেরিক) দক্ষতাগুলো পাঠ্যক্রমে সন্নিবেশ করতে হবে এবং শিক্ষাদানপ্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের দক্ষতা অর্জনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

যদিও একাডেমিক কোর্সের বিষয়বস্তুতে দক্ষতাগুলো যুক্ত করার কাজ অবশ্যই কঠিন, তবে এটি অসম্ভব নয়। কারণ, আমাদের শিক্ষাবিদদের সদ্য প্রবর্তিত আউটকাম-বেজড এডুকেশনের (ওবিই) পাঠ্যক্রমে অ্যাপ্লিকেশন, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও জটিল সমস্যা সমাধানের বৈশিষ্ট্যগুলো অন্তর্ভুক্ত করার দক্ষতা এই সক্ষমতা প্রমাণ করে।

পাঠ্যক্রম তৈরি করার সময় শিক্ষকদের প্রথমে বিষয়বস্তুর সঙ্গে দক্ষতাগুলো একীভূত করার কোর্সগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং তারপর ওই সব কোর্সের বিষয়বস্তুতে দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বর্তমানে এই একীভূত করার বিষয় নিয়ে অনেক গবেষণাপত্র ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচলিত শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতি একটি ট্র্যাডিশনাল শিক্ষামূলক পদ্ধতি, যেখানে একজন শিক্ষক একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের একটি বিষয় সম্পর্কে তথ্য প্রদান করেন বা উপস্থাপন করেন।

শিক্ষক কথা বলেন আর শিক্ষার্থীরা শোনেন ও নোট নেন। এটি ব্যাপকভাবে লেকচারদান, পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে, যা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের জন্য নিষ্ক্রিয়তা এবং নিষ্ক্রিয় শিক্ষার দিকে পরিচালিত করে।

আজকের যুগে যেখানে তথ্য সহজলভ্য, সেখানে এই পদ্ধতি কম কার্যকর ও অনাকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রকেন্দ্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতিগুলোর মধ্যে প্রজেক্ট-বেজড লার্নিং, ফ্লিপড ক্লাসরুম, প্রবলেম-বেজড লার্নিং এবং এক্সপেরিয়েনশিয়াল লার্নিং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এসব পদ্ধতির ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা যেতে পারে।

ফ্লিপড ক্লাসরুমস লার্নিংয়ে শিক্ষার্থীরা প্রথমে শ্রেণিকক্ষের বাইরে লেকচার ভিডিও দেখে বা পড়াশোনা করেন এবং তারপর ক্লাসে আসেন হাতে–কলমে শিখতে ও আলোচনায় অংশ নিতে।

এটি গণিত, কম্পিউটার সায়েন্স, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, নার্সিং, ফার্মেসি ও ফিজিক্যাল থেরাপিতে কার্যকর। এটি ব্যবসায়িক স্কুলে কেস স্টাডি ও গ্রুপ প্রজেক্ট এবং ভাষা প্রোগ্রামে ইন্টারঅ্যাকটিভ অনুশীলনের জন্যও উপযোগী। তবে কলা ও মানবিক শিক্ষায় এই পদ্ধতির ব্যবহার কম।

পিবিএল একটি শিক্ষাদানপদ্ধতি; যা জটিল, বাস্তব জগতের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শিক্ষণের সূচনা করে। এটি চিকিৎসা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, দন্ত চিকিৎসা, প্রকৌশল ও আইন প্রোগ্রামে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতির সফলতা নির্ভর করে প্রণীত সমস্যাগুলোর উপযুক্ততা, দক্ষ শিক্ষকের পরিচালনা এবং শিক্ষার্থীদের শেখা ও আত্মসমালোচনার জন্য জোরালো সমর্থনের ওপর।

প্রজেক্ট-বেজড শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের বাস্তব প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত করে তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ সমাধানে উৎসাহিত করে। এটি বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

এটি শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার উন্নয়ন ও ওয়েবসাইট উন্নয়নে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। এটি সৃজনশীল ক্ষেত্রগুলোতেও ব্যবহৃত হয়, যেমন চারুকলা, গ্রাফিক ডিজাইন ও চলচ্চিত্র নির্মাণে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং নেতৃত্বের দক্ষতা উন্নত করা হয়।

এক্সপেরিয়েনশিয়াল লার্নিং, যা হাতে-কলমে অভিজ্ঞতার ওপর জোর দেয়, স্নাতক প্রোগ্রামগুলোতে অত্যন্ত মূল্যবান। দক্ষতা উন্নয়ন ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগের জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর।

ব্যবসা, প্রকৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপ বা সমবায়–শিক্ষণের মাধ্যমে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা লাভ করা যায়। এটি স্বাস্থ্যসেবা প্রোগ্রামগুলো, যেমন নার্সিং, ফিজিক্যালথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপিতে কার্যকর। যার মাধ্যমে রোগীর যত্নের দক্ষতা ও পেশাদার দক্ষতা উন্নত করা যায়।

রন্ধনশিল্প ও আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রামগুলো রান্নাঘর, রেস্তোরাঁ ও হোটেলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যবহারিক দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়।

কোনো কোর্সের শিক্ষাদানের জন্য কোন পদ্ধতি উপযুক্ত, তা নির্ধারণে দক্ষতা অর্জনে শিক্ষাবিদদের লিটারেচার অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিছু কোর্স মূলত তাত্ত্বিক জ্ঞানের ওপর জোর দেয়। শিক্ষকেরা এ ধরনের কোর্সগুলো কার্যকরভাবে শিক্ষাদানের জন্য ছাত্রকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি একসঙ্গে মিলিয়ে পড়াতে পারেন।

আজকের গতিশীল চাকরির বাজারে এবং দ্রুত বিকশিত প্রযুক্তির ল্যান্ডস্কেপে গ্র্যাজুয়েটদের কেবল বিষয়–নির্দিষ্ট জ্ঞানই নয়, জেনেরিক দক্ষতা অর্জন অত্যাবশ্যক। এসব দক্ষতা কোর্স বিষয়বস্তুর সঙ্গে একীভূত করার এবং শিক্ষাবিদদের প্রথাগত তাত্ত্বিক জ্ঞানদানের মতো সেগুলো সঠিক শিক্ষাদানপদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আয়ত্ত করানোর দক্ষতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

  • এম এম শহিদুল হাসান সাবেক উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

shahidul7371@gmail.com