বাংলাদেশের নির্বাচনটি যে এখন আর বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিতেই প্রমাণিত হলো। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র র্যাব ও এর সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলেও সেটি নির্বাচন–সংশ্লিষ্ট ছিল না। তা ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেটি পরিচালিত হচ্ছে বলেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দাবি করে থাকে। কিন্তু তাঁরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেন না। গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা আনল। স্বৈরাচারকে হটাল। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্র অধরাই থেকে গেল। রাজনৈতিক দলগুলো বরাবর নিজেদের সুবিধামতো গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সংজ্ঞা ঠিক করে। ক্ষমতার বাইরে থাকতে তাদের কাছে যা পরম গ্রহণীয়, ক্ষমতায় গেলে তা চরমভাবে বর্জনীয়। এই ধারাই আমরা গত ৩২ বছর ধরে দেখে আসছি।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, যার মূল কথা হলো যারা সুষ্ঠু নির্বাচন ও জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করবে, তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভিসা দেওয়া হবে না। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের ওপর ভিসা–সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জারি করেছে, তার মধ্যে আছে লাইবেরিয়া, উগান্ডা, নাইজেরিয়া, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া। বিশ্বদরবারে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখা বাংলাদেশকে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই স্তরে নিয়ে এসেছেন।
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের ওপর প্রকারান্তরে ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞা’ জারি করল, সেটি দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় তারা খুশি। সরকার ও সরকারি দল খুশি আগের মতো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি বলে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় যাদের নাম রেখেছে, তাতের মধ্যে সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী দলের রাজনীতিকদেরও কথাও বলেছে। নির্বাচন বর্জনের নামে তারা জ্বালাও–পোড়াও করতে পারবে না। আর বিরোধী দল খুশি এই ভেবে যে সরকারি দলের নেতা, মন্ত্রী, সাবেক ও বর্তমান আমলারাও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির আওতায় রয়েছেন। এখন হয়তো তারা নির্বিঘ্নে সভা–সমাবেশ করতে পারবে। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করা সহজ হবে।
ভাবখানা এমন যে আমেরিকাই আওয়ামী লীগের হয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনটি করে দেবে কিংবা বিএনপির হয়ে আন্দোলনটি সফল করবে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ এই ভিসা নীতির লক্ষ্যবস্তু না হয়েও খুশি হতে পারছে না। তাদের মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচন নিয়ে অন্য একটি দেশ নিষেধাজ্ঞা দেবে, এটি যেকোনো আত্মমর্যাদাশীল নাগরিকের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন।
কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে যে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ, তাদের খুব বেশি চাওয়ার নেই। তারা রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হতে চায় না। তারা মন্ত্রী-এমপিও হতে চায় না। তারা চায় পেট পুরে দুই বেলা খেতে। আর পাঁচ বছর পরপর একটা ভোট দিতে। সংবিধানে লেখা আছে, জনগণই এই রাষ্ট্রের মালিক। ভোটই হলো সেই মালিকানা নির্ধারণের উপায়।
নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকলেন, যাতে বহুচর্চিত বাংলা প্রবাদটির কথাই মনে করিয়ে দেয়। সরকারের মন্ত্রীরা তারস্বরে প্রচার করছেন, এই নিষেধাজ্ঞা তাঁদের ওপর প্রযোজ্য নয়। তাঁরা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনই করতে চান। এটি তাঁদের জন্য প্রযোজ্য, যারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়। অন্যদিকে বিরোধী দলের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করেছে বলেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এর মাধ্যমে তাঁদের দাবিই যৌক্তিকতা পেয়েছে। কিন্তু কোনো পক্ষই এটা বলছে না যে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা কিংবা সতর্কবার্তা জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট করেছে।
স্বাধীনতার পর মূলত তিনটি দলই ক্ষমতায় ছিল এবং আছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। মাঝেমধ্যে তারা ছোট শরিকদের সঙ্গে নিয়েছে। কিন্তু তিন দলের কেউই বিশেষ ব্যবস্থা বা বিধান ছাড়া দেশবাসীকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারেনি। গণতন্ত্র আকাশ থেকে পড়ে না। মাটির থেকেও গজায় না। গণতন্ত্র হলো অব্যাহত অনুশীলন। গণতন্ত্র হলো সব দল ও মতের মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে চলা। একসঙ্গে চলা মানে অন্যের মত মেনে নেওয়া নয়। বরং অন্যের মতের ত্রুটি-দুর্বলতা জনগণের কাছে তুলে ধরে নিজে সমর্থন আদায় করবে।
আরেকটি বিষয়, ক্ষমতার বাইরে থাকলে সব দলই গণতন্ত্রের কথা বলে। নাগরিকদের মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বুলন্দ আওয়াজ তোলে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে সবকিছু ভুলে যায়। অতীতে ক্ষমতাসীনেরা যেভাবে জনগণের অধিকার হরণ করেছে, তারাও সেই পথ অনুসরণ করে চলে। ফলে কোনো সরকারই বিপুল ও বিস্ময়কর উন্নয়ন(!) করা সত্ত্বেও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারে না। এ অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের জবরদস্তি করা ছাড়া উপায় থাকে না।
পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই বলে বাংলাদেশেও সেই ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রীরা বক্তৃতা করেন। কিন্তু যেসব কারণে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলো দূর করতে কোনো উদ্যোগ নেন না।
যেসব দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেসব দেশে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করে, সেসব দেশে কিন্তু কেউ নির্বাচন বর্জনের কথাও বলেন না। সম্প্রতি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে নির্বাচন হলো। কেন্দ্রে প্রচণ্ড প্রতাপশালী বিজেপি সরকার, রাজ্যেও তাদের সরকার ছিল। এরপরও নির্বাচনে তারা হেরে গেছে। কংগ্রেস জিতেছে। বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে বিরোধী দল জিতেছে, এ রকম প্রমাণ নেই। ক্ষমতাসীনেরা বরাবর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রভাবিত করে যেকোনো মূল্যে জয়ী হন। আগে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে কিছুটা রাখঢাক ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেটিও উঠে গেছে। নির্বাচনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে সে কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, মার্কিন নতুন ভিসা নীতির ফলে বিএনপি আর নির্বাচন বানচাল বা প্রতিরোধ করতে পারবে না। সেই পরীক্ষা দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। তফসিল ঘোষণার পরই প্রশ্ন আসবে কে নির্বাচনে অংশ নেবে, কে প্রতিরোধ করবে। তার আগে আগামী ছয়-সাত মাসে দেশের মানুষ এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের ভাষায় ‘সারা দুনিয়া’ দেখতে চাইবে সরকার কীভাবে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করে? নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটা রক্ষা করে? তারা আরও দেখতে চাইবে বিরোধী দলের সমাবেশে কারা হামলা করে? কারা শান্তি সমাবেশের নামে অশান্তি তৈরি করে। কোন দলের কতজন নেতার নামে কতটি মামলা আছে? কোন দলের মিছিল বা সমাবেশে কারা হামলা করে?
সম্প্রতি রাজশাহীর জেলা বিএনপির নেতা আবু সাইদ প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা ছিল চরম উসকানিমূলক। আমরা এর নিন্দা করি। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়েছে। কিন্তু একইভাবে সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সম্পর্কে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেন, তখন সরকার একেবারেই নির্বিকার। আইনের গতি হঠাৎ থেমে যায়।
লেখাটি শুরু করেছিলাম মার্কিন নতুন ভিসা নীতিতে সরকার ও বিরোধী দলে প্রতিক্রিয়া নিয়ে। দুই পক্ষই নিজ নিজ সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে আত্মতুষ্টি লাভের চেষ্টা করছে।
ভাবখানা এমন যে আমেরিকাই আওয়ামী লীগের হয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনটি করে দেবে কিংবা বিএনপির হয়ে আন্দোলনটি সফল করবে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ এই ভিসা নীতির লক্ষ্যবস্তু না হয়েও খুশি হতে পারছে না। তাদের মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচন নিয়ে অন্য একটি দেশ নিষেধাজ্ঞা দেবে, এটি যেকোনো আত্মমর্যাদাশীল নাগরিকের জন্য মেনে নেওয়া কঠিন।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশকে আর কতটা নিচে নামাবেন?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি।
ইমেইল: sohrabhassan55@gmail.com