‘ইদ’ না ‘ঈদ’—এটা নিয়ে বেশ কাজিয়া আছে। বাঙালির স্বাভাবিক উচ্চারণে ‘ইদ’ বানানটি যথার্থ মনে করি। আমি ভাষাপণ্ডিত নই। ‘ঈদ’ বানানটি চলে আসছে অনেক দিন ধরে। আপাতত আমি রক্ষণশীলতার পক্ষেই থাকলাম। আমার অনুমান, পাঁচ-দশ বছর পরে এটা থাকবে না। আমার শৈশবে যে বানানরীতি ছিল, তা অনেক বদলে গেছে। তখন পড়তাম—লিখতাম বাড়ী, গাড়ী, পাখী, শাড়ী, রানী, বাঙালী। এখন পড়ি—লিখি বাড়ি, গাড়ি, পাখি, শাড়ি, রানি, বাঙালি। দিন দিন সহজ হচ্ছে ভাষা। কমছে শুচিবাই।
রাত পোহালেই অনেক দেশে ঈদ। আল্লাহর দুনিয়া বান্দারা ভাগ করে খণ্ডবিখণ্ড করেছে। একেক খণ্ডে ঈদ একেক দিনে। এখন যে ঈদ, তার নাম ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের কাছে এটা তাঁদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। আমাদের দেশে আমরা বলি রোজার ঈদ। এটা হলো রোজা ভাঙার উৎসব। এক মাস রোজা রাখার পর এদিন আমরা আনন্দ করি। হিজরি দ্বিতীয় সনে এটি মদিনায় চালু হয়।
ঈদের কথা মনে হলেই ফিরে যাই শৈশবে। সারা বছর এই দিনটির জন্য মুখিয়ে থাকতাম। ঈদের চাঁদ দেখতে জড়ো হতাম মাঠে কিংবা ছাদে। নতুন চাঁদ দেখার জন্য সেকি আকুলি-বিকুলি!
ঈদের দিন আমাদের জন্য বরাদ্দ থাকত নতুন জামা। দরজিকে দিয়ে বানানো কিংবা রেডিমেড কেনা হতো। কাপড় পুরোনো হয়ে যাবে বলে ঈদের আগে এটা বন্ধুদের দেখাতাম না। লুকিয়ে রাখতাম আর ক্ষণে ক্ষণে নতুন কাপড়ের গন্ধ শুঁকতাম। কাপড় পছন্দ না হলে কান্নাকাটি করতাম। আসলে যেকোনো পালা-পার্বণে শিশুরাই আনন্দ করে বেশি। শিশুর মুখে হাসি দেখার জন্য মা–বাবার চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। সেদিন বাসায় ভালো কিছু রান্না হয়। খাওয়া বলতে প্রথমেই মনে আসে পোলাও-কোরমা আর সেমাই-জর্দা-ফিরনির কথা।
ঈদে কিছু সরকারি কর্মসূচি থাকে। তার একটি হলো নির্দিষ্ট কিছু লোকের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা। সরকারের ঘোষণা থাকে ঈদ উপলক্ষে জেলখানা, এতিমখানা, শিশুসদন ও হাসপাতালে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হবে। যাঁরা এসব জায়গায় থেকেছেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন কী খেয়েছেন।
বাল্যকাল থেকেই জানি, ঈদ মানে খুশি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী এই গানের সুর এখন সব টিভি চ্যানেলে বাজানো হয়, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ…।’ মানুষ কেনাকাটা করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে শপিংমলে। প্রিয়জনের জন্য উপহারসামগ্রী কেনে। সবাই আনন্দের উপলক্ষ খোঁজে।
এই নিয়ম এখনো আছে। তেঁতুলিয়ায় চাঁদ দেখা গেলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও একই দিন ঈদ হবে। কেউ কেউ সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা-ঈদ উদ্যাপন করেন। তাঁদের যুক্তি হলো, আল্লাহর দুনিয়ায় যেখানেই চাঁদ দেখা যাবে, সবাই সেটা মেনে পালা-পার্বণ উদ্যাপন করবেন। এ নিয়ে সমাজে বাহাস আছে। যাঁর যা বিশ্বাস, তিনি সে অনুযায়ী চলেন। ইসলামিক ঐক্য সংস্থার অনেক সদস্যরাষ্ট্র একই দিন রোজা শুরু ও ঈদ উদ্যাপনের পক্ষে। কিছু দেশের আপত্তির জন্য এই প্রস্তাব পাস হচ্ছে না।
তবে ঈদ সবার জন্য খুশির বার্তা নিয়ে আসে না। সবার অবস্থা এক রকম নয়। অনেকেই গরিব, দিন আনে দিন খায়। পত্রিকার প্রথম পাতায় কোনো শিশুশ্রমিক বা দিনমজুরের ছবি দিয়ে লেখা হয়, তাঁদের জীবনে কি ঈদ এসেছে? আবারও শরণ নিতে হয় নজরুলের ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায়:
বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্থানে।…
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পাঁজরের হাড়?...
ঈদের কিছু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা আছে। যেমন সকালে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ পড়তে হয়। এর বাইরে যে উৎসব, তাতে যে কেউ অংশ নিতে পারেন। আমি তো সব সময় চেষ্টা করেছি আমার অমুসলিম দেশি-বিদেশি সহকর্মী ও বন্ধুদের ঈদের দিনে বাসায় দাওয়াত দিতে। এটা হলো সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। এ অর্থে ঈদ একটি সর্বজনীন উৎসব। এখন এ উৎসবে যোগ দেয় অনেক বিদেশি দূতাবাস। সংবর্ধনার আয়োজন করেন অনেক ‘অমুসলিম’ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান।
ঈদ উপলক্ষে আগে ঈদকার্ড পাঠানোর চল ছিল। নানা রকমের ছাপানো বাহারি ঈদকার্ড বিক্রি হতো। কার্ড কিনলে খাম ফ্রি। নিউমার্কেটে দেখেছি, ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে বই ও স্টেশনারি দোকানগুলোতে শুধু ঈদকার্ড বিক্রি হতো। চারুকলার ছাত্র-শিক্ষকদের আঁকা জলরঙের কার্ড পাওয়া যেত চার আনা-আট আনায়। এখন এসব উঠে গেছে। সবাই এখন ই-মেইল আর ফেসবুকে ঈদের শুভেচ্ছা দেন, নিখরচায়। তাঁদের বার্তা পৌঁছে যায় আলোর গতিতে। তবে তাতে প্রাণের ছোঁয়া থাকে কি?
আমাদের সমাজে ঈদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে হওয়া। অনেক মানুষ শহরে ভিড় করেন পড়াশোনা বা কাজের সন্ধানে। ঈদের ছুটিতে তাঁরা ছোটেন শিকড়ের দিকে, গ্রামে। এ বছর ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে গত বুধবার। প্রথম দিনেই ঢাকা ছেড়ে গেছেন ১২ লাখ মানুষ। মুঠোফোন ট্র্যাক করে এই হিসাব করা হয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়বে। আন্দাজ করা যায়, ঢাকা মহানগরীর কোটি মানুষ গ্রামে বা মফস্সল শহরে যাবেন স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে। শত ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা যাবেন বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, নৌকায়। পারিবারিক বন্ধনের এই যে সংস্কৃতি বা প্রবণতা, এটা বিশ্বে অনন্য।
ঈদে শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ থাকে না। এটা মনের মধ্যে হিংসা ও বিদ্বেষ পুষে রাখার দিন নয়। পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিবিদেরা এদিন নামাজ শেষে কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন, এটাই প্রত্যাশা। তবে এখন এটি আর হয়ে ওঠে না। অনেকেরই মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ঈদের দিনেও তাঁরা এই বিরাগ জারি রাখেন। ঈদ উপলক্ষে আমাদের নেতারা বাণী দেন। সেখানে সাম্য, ঐক্য আর সহমর্মিতার আহ্বান থাকে। তারপরও তাঁদের ঝগড়া চলে, সমাজে বিভাজন থাকে, প্রতিহিংসা বন্ধ হয় না।
লেখাটা শেষ করব ছোট একটা ঘটনা দিয়ে। তখন ছিল পাকিস্তান। স্কুলে পড়ি। পূর্ব পাকিস্তানের কোথাও শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায়নি। রাত নয়টার দিকে রেডিওতে জানানো হলো, পরদিন ঈদ। কারণ, পেশোয়ারে চাঁদ দেখা গেছে। এ নিয়ে দুটো মত তৈরি হয়। অনেকেই ২৯ রোজা শেষে বাজারে ছোটেন কেনাকাটা করতে। তাঁরা পরদিন ঈদ উদ্যাপন করেন।
আবার অনেকেই সেদিন রোজা রাখেন এবং তার পরের দিন হয় তাঁদের ঈদ। ফলে এক দিন হয় সরকারি ঈদ, আরেক দিন হয় বেসরকারি ঈদ। খাইবারে চাঁদ দেখা গেলে টেকনাফেও তা দেখা গেছে বলে ধরে নিতে হতো। কারণ, দেশ একটাই।
এই নিয়ম এখনো আছে। তেঁতুলিয়ায় চাঁদ দেখা গেলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও একই দিন ঈদ হবে। কেউ কেউ সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা-ঈদ উদ্যাপন করেন। তাঁদের যুক্তি হলো, আল্লাহর দুনিয়ায় যেখানেই চাঁদ দেখা যাবে, সবাই সেটা মেনে পালা-পার্বণ উদ্যাপন করবেন। এ নিয়ে সমাজে বাহাস আছে। যাঁর যা বিশ্বাস, তিনি সে অনুযায়ী চলেন। ইসলামিক ঐক্য সংস্থার অনেক সদস্যরাষ্ট্র একই দিন রোজা শুরু ও ঈদ উদ্যাপনের পক্ষে। কিছু দেশের আপত্তির জন্য এই প্রস্তাব পাস হচ্ছে না।
ঈদ সবার জন্য আনন্দময় হোক। শুভ হোক জীবন।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক