তিন বছর ধরে গাছের কাছে এলেই মোজাম্মেলের মনে হয়, গাছটা কষ্ট পাচ্ছে।
তিন বছর ধরে গাছের কাছে এলেই মোজাম্মেলের মনে হয়, গাছটা কষ্ট পাচ্ছে।

আমগাছটা কি চোর?

গাছের কাছে এলেই মোজাম্মেল হোসেনের মনে হয়, গাছটা কি চোর? চোরের কোমরে যেভাবে দড়ি বেঁধে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, গাছটিরও সেই দশা। শুধু পার্থক্য হচ্ছে, মানুষের কোমরে দড়ি পড়ে আর গাছটাকে বাঁধা হয়েছে লোহার তার দিয়ে। তিন বছর ধরে গাছের কাছে এলেই মোজাম্মেলের মনে হয়, গাছটা কষ্ট পাচ্ছে।

তিনি গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। প্রতিবছর গাছটিতে ১০ থেকে ১২ মণ আম ধরত। লোহার তার দিয়ে বাঁধার পর থেকেই আম ধরা কমে আসছে। এ বছর তাঁর এই গাছে একটি আমও ধরেনি। মোজাম্মেলের ধারণা, বাঁধার কারণেই গাছটিতে আম ধরা বন্ধ হয়ে গেছে।

মোজাম্মেল হোসেনের বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার মুরারীপুর গ্রামে। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কের দক্ষিণ পাশেই তাঁর বাড়ি। সেখানেই তাঁর ক্ষীরশাপাতি জাতের আমের গাছটি। এ জাতের আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি বাংলাদেশের একটি উৎকৃষ্ট জাতের আম। স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। বাজারের সেরা দামে এই আম বিক্রি হয়।

মোজাম্মেলের হিসাব অনুযায়ী, তাঁর এই গাছের সর্বনাশ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তারা বিদ্যুতের লাইন সোজা রাখার জন্য তাঁর গাছের সঙ্গে তার পেঁচিয়ে বিদ্যুতের লাইনের সঙ্গে টানা দিয়েছে। তিন বছর ধরে গাছটির সঙ্গে এই তার জড়ানো রয়েছে। ফলে বাকল কেটে তার গাছের গায়ের ভেতরে ঢুকে গেছে। তাঁর ভাষ্যমতে, বিদ্যুতের লাইন করার সময় তাঁরা বলেছিলেন, কিছুদিন পরে তাঁরা এসে গাছ থেকে তার খুলে দিয়ে যাবেন। তবে এই দীর্ঘ সময়ে তাঁরা আর আসেননি।

এ বছর গাছে একটি আমও ধরেনি দেখে কৃষক মোজাম্মেল বিচলিত বোধ করেন। তিনি স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করেন। তাঁরা বলেছেন, তাঁদের ইঞ্জিনিয়ার ঢাকায় গেছেন। তিনি ফিরলে একটা ব্যবস্থা হবে। এরপর এক মাস পার হয়ে গেছে। কেউ তাঁর গাছের খোঁজ নিতে আসেননি।

৫ জুলাই মুরারীপুর গ্রামে গিয়ে অবস্থা দেখে গাছটিকে চোরের মতোই মনে হয়। পুলিশ যেভাবে চোরের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়, সে রকম অবস্থা। মনে পড়ল, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নয় হাজার টাকা ঋণের দায়ে সাতক্ষীরার একজন কৃষকের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ। সেই ছবি প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। একজন সেনা কর্মকর্তার অনুকম্পায় সেই কৃষক ঋণমুক্ত হয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন। কিন্তু এই গাছটির কী হবে?  

ফোন ছেড়ে দিয়ে ভাবলাম, ১২৩ বছর আগে জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন, গাছেরও প্রাণ আছে। আমাদের অনেক কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে, আমরা বোধ হয় গন্ডারের চামড়া গায়ে দিয়ে আছি অথবা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে আছি। কিন্তু রাজশাহীর আম আর বিদ্যুৎ লাইনের মতো বিপজ্জনক ব্যাপার যেখানে জড়িয়ে আছে, সেখানে আমাদের বোধ হয় আরেকটু সচেতন হওয়ার দরকার।

আসলেই কি এভাবে তার জড়িয়ে রাখলে গাছের কোনো ক্ষতি হয়? জানার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম মনজুর হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলি। শুনেই তিনি আঁতকে উঠলেন। বললেন, গাছের বাকলের নিচেই থাকে ‘ফ্লোয়েম টিস্যু’, যার মাধ্যমে গাছের দেহের বিভিন্ন অংশে খাদ্য পরিবাহিত হয়। তার দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে এই টিস্যুর ক্ষতি হচ্ছে। ফলে গাছ খাদ্য পাচ্ছে না। এ জন্য আম ধরছে না। কৃষকের ধারণা ঠিক আছে।

এবার কৃষকের হয়ে একটু তদবির করার জন্য নিকটস্থ বিদ্যুৎ অফিসের একজন উপসহকারী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁর নাম মোজাম্মেল হক। তিনি রাজশাহী নগরের কাশিয়াডাঙ্গা কার্যালয়ে বসেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই কৃষকের অভিযোগের কথা মনেই করতে পারলেন না। সুবিধার জন্য তাঁকে কৃষক মোজাম্মেল হোসেনের মুঠোফোন নম্বর দিই।

কিছুক্ষণ পরে ওই উপসহকারী প্রকৌশলী ফোন করে বললেন, ‘আরে ভাই, ওই কৃষক তো ক্ষেপে আছেন। তিনি ভালো করে কথাই বলতে চান না।’ আমি তাঁকে কৃষকের মনের অবস্থা বোঝানোর চেষ্টা করি। তারপর তিনি গুরুত্ব দিয়ে কথাগুলো শুনলেন।

বললেন, ‘এটা ওই ঠিকাদারের কাজ। আরেকটি পিলার পুঁতে তার সঙ্গে লাইনের টানা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারের।’ বললাম, তিনি এভাবে রেখে দিয়েছেন। এখন কে করবে? খানিকটা চিন্তা করে তিনি বললেন, ‘না হয় তার খুলে দিতে বলেন।’ বললাম, খুলে দিলে যদি বিদ্যুৎ লাইন কাত হয়ে পড়ে যায়? এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘অনেক জায়গায় খুঁটি কাত হয়েও থাকে।’ তাঁকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি, এই কাজ করা মোটেও ঠিক হবে না। এবার ভেবেচিন্তে তিনি বললেন, ‘এই বৃষ্টিবাদল ছুটে গেলে তাঁকে বলবেন, ফোন করে যেন বিষয়টা আমাকে মনে করিয়ে দেন।

ফোন ছেড়ে দিয়ে ভাবলাম, ১২৩ বছর আগে জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন, গাছেরও প্রাণ আছে। আমাদের অনেক কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে, আমরা বোধ হয় গন্ডারের চামড়া গায়ে দিয়ে আছি অথবা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে আছি। কিন্তু রাজশাহীর আম আর বিদ্যুৎ লাইনের মতো বিপজ্জনক ব্যাপার যেখানে জড়িয়ে আছে, সেখানে আমাদের বোধ হয় আরেকটু সচেতন হওয়ার দরকার।

আর রাজশাহী আমের দেশ। যদিও এখন সারা দেশেই কমবেশি আমের চাষ হচ্ছে, কিন্তু রাজশাহীর মতো সুস্বাদু আম অন্য জায়গায় কমই হয়। রাজশাহীতে যে কৃষকের একটি আমের গাছ আছে, তিনিও সুখী মানুষ। তাঁর মনের অবস্থাটা বিদ্যুৎ বিভাগকেও বুঝতে হবে।

  • আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
    নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী