মতামত

ঘুষ–দুর্নীতি ঠেকাতে প্রযুক্তি কতটা ভূমিকা রাখতে পারে

গত অক্টোবরের শেষে ভিয়েনায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টিকরাপশন একাডেমির (আইএসিএ) বার্ষিক সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানে ৮১টি সদস্যদেশের প্রতিনিধিরা সংগঠনের দুর্নীতিবিরোধী মিশন নিয়ে আলোচনা করেছেন। শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়ানোর প্রোগ্রাম এবং গবেষণার মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা ছিল এ মিশনের মূল লক্ষ্য। দুর্নীতি সাধারণত সবচেয়ে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। দুর্নীতি দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে শুধু রাজনৈতিক সমস্যায় ফেলে না; বরং তা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ট্র্যাজেডিও ডেকে আনে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতি প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ২৬ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি করে, যা বৈশ্বিক জিডিপির ৫ শতাংশ। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অত্যাবশ্যকীয় সেবার তহবিল আরও সংকুচিত হয়ে যায়। দুর্নীতি মোকাবিলায় ডিজিটাল ব্যবস্থা বা সরঞ্জামগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং রাখা উচিত। সরকার এ ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, জবাবদিহি নিশ্চিত ও জনগণকে অধিকতর ক্ষমতায়িত করতে পারে। 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডিজিটাল টুল কার্যকর হতে হলে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ভুল কাজ চিহ্নিত করার দক্ষতা থাকতে হবে এবং সেরা পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এ লক্ষ্যেই আইএসিএ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে জোর দিচ্ছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখানো ছোটবেলা থেকেই স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত; পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসার নেতৃত্ব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিতভাবে কার্যকর ও দক্ষ দুর্নীতিবিরোধী পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। 

তবে আইএসিএর বৈঠকে উপসংহার টানা হয়েছে—প্রযুক্তি একা দুর্নীতির সমাধান করতে পারে না। এ জন্য নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ নিতে হবে, যথাযথ নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টি দেখাতে হবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

প্রথমত, প্রযুক্তি সরকারি পরিষেবাগুলোয় ডিজিটালাইজেশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করতে পারে। জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো প্রায়ই ঘুষ ও দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই সেবাগুলো সহজ ও স্বয়ংক্রিয় করা হলে সরাসরি মুখোমুখি যোগাযোগ কমবে। এতে দুর্নীতির সুযোগও হ্রাস পাবে। 

যেমন ই-গভর্নমেন্টে অগ্রণী দেশ এস্তোনিয়া তাদের প্রায় সব সরকারি পরিষেবাকে ডিজিটাল করেছে। সেখানে ট্যাক্স দেওয়া থেকে ব্যবসা নিবন্ধন পর্যন্ত সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। এটি স্বচ্ছতা বাড়ায় এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ঘুষ নেওয়া কঠিন করে তোলে। 

সরকারগুলো দুর্নীতি শনাক্ত ও প্রতিরোধের জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও (এআই) ব্যবহার করতে পারে। ব্লকচেইনভিত্তিক সরকারি প্রকিউরমেন্ট সিস্টেম টেন্ডার প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে একটি স্বচ্ছ ও অপরিবর্তনীয় রেকর্ড তৈরি করবে। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার করে সরকার অবৈধ আর্থিক প্রবাহ (যা প্রায়ই কর ও শুল্ক রাজস্ব থেকে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি করে) শনাক্ত করছে। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়—এমন সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন বা প্রকিউরমেন্ট ডেটায় অসামঞ্জস্য প্যাটার্ন ও অসংগতি চিহ্নিত করতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থা আগাম হস্তক্ষেপ করতে সহায়তা করে এবং দুর্নীতির বেড়ে ওঠাকে রুখে দেয়। 

হুইসলব্লোয়ারদের মাধ্যমে ইতিমধ্যে বিশ্বের বড় বড় দুর্নীতি–কেলেঙ্কারির রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। এ কারণে দুর্নীতি ও ঘুষের ঘটনা রিপোর্ট করার জন্য নীতিনির্ধারকদের এমন এনক্রিপ্টেড ব্যবস্থা চালু করা উচিত, যা মানুষকে গোপনীয়তা বজায় রেখে অভিযোগ জানাতে সক্ষম করে। 

এই প্ল্যাটফর্মগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাগরিকদের দ্রুত ও ভয়মুক্তভাবে কথা বলতে সাহায্য করে। এতে সরকার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার চাপ সৃষ্টি হয়। 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডিজিটাল টুল কার্যকর হতে হলে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ভুল কাজ চিহ্নিত করার দক্ষতা থাকতে হবে এবং সেরা পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এ লক্ষ্যেই আইএসিএ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে জোর দিচ্ছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখানো ছোটবেলা থেকেই স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত; পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসার নেতৃত্ব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিতভাবে কার্যকর ও দক্ষ দুর্নীতিবিরোধী পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। 

এ ছাড়া সরকারকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং আইনি ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে। 

দুর্নীতিবাজদের সাজা দিতে হলে শক্তিশালী আইনি কাঠামো, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরিহার্য। এগুলো ছাড়া সেরা প্রযুক্তিও বাস্তবে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারবে না। 

আজলিনা ওসমান সাইদ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরবিষয়ক (আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার) মন্ত্রী

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত