বিষয়টা আদর্শিকভাবে আমরা বুঝতে চাই, সরকারের সব কর্মকাণ্ড জনগণের বা ভোক্তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করবে এবং তাদের স্বার্থের অনুকূলে থাকবে বা সাংঘর্ষিক হবে না। এই মানদণ্ডে হিসাব করলে এভাবে জ্বালানির বেপরোয়া ও ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে মূল্যবৃদ্ধিতে আমরা হতবাক। আমরা বিশেষভাবে অনুধাবন করেছি, উত্তরোত্তর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি—এর আগে জ্বালানি তেলের প্রতি লিটারে ১৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিও অপেক্ষাধীন—এর মধ্যে জ্বালানি তেলের প্রায় ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের একটি অবিশ্বাস্য চারিত্রিক দিক ওঠে এসেছে। যার মধ্য দিয়ে বলা যায়, সরকার এখন আর জনগণের কল্যাণ নিয়ে ভাবে না। কারণ, সরকারের ভেতরে অসাধু একটি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করছে। এতে আমরা অনেক বেশি আতঙ্কিত ও হতভম্ব।
সরকার বলছে, তারা নিরুপায় হয়ে জ্বালানির এ মূল্যবৃদ্ধি করেছে। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় দেখতে পেলাম, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যে ঋণ প্রদানে সম্মত হয়েছে, সেখানে সরকারের ঘাটতি কমিয়ে আনার শর্ত আরোপ করেছে। আমরাও তো চাই ঘাটতি কমাতে। আমরা বলেছি, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, এলএনজি, এলপিজি—সব ক্ষেত্রে সাপ্লাই পর্যায়ে উৎস থেকে শুরু করে একেবারে ভোক্তার পর্যায় পর্যন্ত যেখানে যত রকমের অপচয় আছে, লুণ্ঠনমূলক ব্যয় আছে, অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সংযোজন আছে—সবকিছু থেকে এ খাতকে মুক্ত করলে অনিবার্যভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার ঘাটতি কমে যায়।
সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে কী না, হলে কত দিতে হবে, সেটি জ্বালানি বিভাগ বা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বলার কথা নয়। বিইআরসির বলার কথা। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে আমরা দেখি, সেটির সঙ্গে সমন্বয় করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানা কৌশল গ্রহণ করে যেমন রাজস্ব কমায়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানি বিপিসি তার মুনাফা কমায়। সরকার ভর্তুকি দিতে না পারলে কেন এসব কৌশল নিল না?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ঘাটতি কতটা এবং তা কীভাবে সমন্বয় করা যায়, সে জন্য এই পণ্যের মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রই সংসদীয় আইন দ্বারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সেই প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। সেই প্রতিষ্ঠানকেই এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, জ্বালানি বিভাগকে নয়। এখন জ্বালানি বিভাগের কেন উপযাচক হয়ে তড়িঘড়ি করে বেপরোয়াভাবে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হলো, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তা-ও যে মুহূর্তে আমরা দেখতে পারছি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, পেট্রল-অকটেন আমরা উৎপাদন করি। চাহিদা পূরণে সেই উৎপাদিত পণ্যই যথেষ্ট; অর্থাৎ পেট্রল-অকটেন আমদানি করা হয় না। তার মানে, এলপিজি মূল্যের ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি, যে অংশ নিজস্বভাবে উৎপাদন করা হয়, সেটির প্রতি সিলিন্ডারের মূল্য ৬০০ টাকা বহাল আছে। অথচ আমদানি করা সিলিন্ডার গ্যাসের মূল্য ১ হাজার ২০০-১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে যায়।
অন্যদিকে নিজস্ব উৎপাদনেরটা ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। এর সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে পেট্রল-অকটেনের মূল্যবৃদ্ধি করে যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা কী করে গ্রাহ্য হয় বা ন্যায্য বলে মেনে নেওয়া যায়। আর যেখানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেছে এবং ক্রমে কমছে, সে সময় বলা হলো ঘাটতি সমন্বয় করতে মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে যে পরিমাণ দাম কমেছে, তা কি মূল্যবৃদ্ধিতে সমন্বয় করা হয়েছে?
সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে কী না, হলে কত দিতে হবে, সেটি জ্বালানি বিভাগ বা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বলার কথা নয়। বিইআরসির বলার কথা। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে আমরা দেখি, সেটির সঙ্গে সমন্বয় করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানা কৌশল গ্রহণ করে যেমন রাজস্ব কমায়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানি বিপিসি তার মুনাফা কমায়। সরকার ভর্তুকি দিতে না পারলে কেন এসব কৌশল নিল না? বিদ্যুৎ উৎপাদনের আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলা করতে সরকার জ্বালানি সাশ্রয় করছে, লোডশেডিং দিচ্ছে। এখন জ্বালানি খাতে রাজস্ব ও মুনাফা না কমিয়ে এবং অন্যান্য অপচয় ও অনিয়ম না ঠেকিয়ে রাতারাতি মানুষের ওপর আবার বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিল।
এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য যে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ ছিল, সেটি গ্রহণ করা হলো না। কেন সরকার বিষয়টি বিইআরসির কাছে পাঠাল না? বিইআরসি খতিয়ে দেখতে পারত। সরকার যে যুক্তিতে আইনবহির্ভূতভাবে এ মূল্যবৃদ্ধি করল, সে অনুসারে তো গ্যাসের মূল্য ১১৭ শতাংশ বাড়ার কথা, বিদ্যুতের মূল্য বাড়ার কথা ৭৯ শতাংশ। কিন্তু গণশুনানিতে তো তার কোনোটাই প্রমাণিত হয়নি; বরং দেখা গেছে, লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বিবেচনা করা না হলে এসব ক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকি অনেক কমে আসে, ঘাটতিও কমে যায়। এমন সব তথ্য-প্রমাণ আমরা গণশুনানিতে দিয়েছি। সেগুলোকে পদদলিত করে জনগণের কল্যাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহনভাড়া, পণ্য পরিবহনের খরচ, সর্বোপরি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। তবে মূল ধাক্কা পড়বে কৃষি উৎপাদনে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে সারের দামও বেড়ে গেছে। কৃষি খরচও বেড়ে গেছে। ফসল উৎপাদনের আগে ও পরে ডিজেলের ব্যাপক ব্যবহার হয়। এখন এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষিতে কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, সেটি ভাবতে গিয়ে আমি আতঙ্কিত হচ্ছি। কৃষি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে যে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি সরকারের জন্য অহংকার ছিল, সেটি এখন কত বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো, বোঝানো যাবে না। সেসব এখন সাধারণ বিচার-বিশ্লেষণের বাইরে চলে গেছে। পাশাপাশি শিল্পোৎপাদনও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। জীবনযাপনে আরও বেশি বিপর্যয় নেমে আসবে। বাজারে মূল্যস্ফীতি তৈরি হবে। আইলা বা সিডরের মতো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি চাইলে আমরা পুষিয়ে নিই এবং নিতেও পারি। কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে, সেটি আদৌ পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কি না, আমি জানি না।
ড. এম শামসুল আলম কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা