অনেক নাটকের পর নির্বাচন কমিশন জানাল, ভোট হবে ব্যালটে। ইভিএম আপাতত বাদ। ইভিএম নিয়ে শুরু থেকেই ভিন্নমত ছিল। কয়েকটি দল সরাসরি আপত্তি জানিয়েছিল। তারপরও নির্বাচন কমিশন ইভিএমের পক্ষে ছিল। কমিশন কয়েকজন ‘বিশেষজ্ঞ’কে দিয়ে আশ্বস্ত করারও চেষ্টা করেছিল, ইভিএমের প্রযুক্তিতে কোনো সমস্যা নেই।
গত বছর মে মাসে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান মাদারীপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘কেউ যদি ইভিএমে কোনো ভুলত্রুটি ধরতে পারেন, তার জন্য আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১০ মিলিয়ন ডলার (১০০ কোটি টাকার বেশি) পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন’ (প্রথম আলো, ৪ এপ্রিল ২০২৩)।
এ জন্য কমিশনের কাছে এ পরিমাণ টাকার বাজেট আছে কি না, জানি না। এটা একটা কথার কথাও হতে পারে। রাজনীতিবিদদের সুরে সুর মিলিয়ে আজকাল নির্বাচন কমিশনাররাও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে শুরু করেছেন। সাংবিধানিক কমিশনের সদস্য হলে কথাবার্তায় লাগাম থাকতে হয়। এত কথা বলার কী দরকার।
ইভিএম নিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টানোর ব্যাপারে কমিশনের সচিব জানিয়েছেন, তিনি এর প্রেক্ষাপট জানেন না। তবে তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ইভিএমের টাকা দিতে অস্বীকার করেছে। কমিশন গত বছর সেপ্টেম্বরে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল। এ টাকায় মেশিন কিনে সাকল্যে অর্ধেকসংখ্যক, অর্থাৎ ১৫০টি আসনে নির্বাচন করতে পারত।
অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সবুজসংকেত দেয়নি। কমিশনের কাছে পড়ে আছে দেড় লাখ মেশিন। এখন সব কটিই অচল। এর মধ্যে ৪০ হাজার মেশিন মেরামতযোগ্য নয়। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার মেশিন মেরামত করে সচল করার জন্য কমিশন ১ হাজার ২৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা চেয়েছিল।
আমরা গরিব—এটা বলতে ইজ্জতে লাগে। বিশ্বব্যাংকের ভাষায় আমরা বলি উন্নয়নশীল। আমাদের সম্পদ সীমিত। চাহিদা অসীম। কোভিডের ঝাপটায় এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপে আমাদের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। হু হু করে বেড়েছে ডলারের দাম। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। দেনা পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে ঊর্ধ্বগামী হয়েছে মূল্যস্ফীতি। নাগরিকেরা জেরবার। ওএমএসের ট্রাকের পেছনে ক্রেতার লাইন দীর্ঘতর হচ্ছে।
এ অবস্থায় এত টাকা খরচ করে মেশিন কেনার চিন্তা তুঘলকি কাণ্ড বলে মনে হয়েছিল। তা-ও আবার ১৫০ আসনে ইভিএম দিয়ে নির্বাচন করার পরিকল্পনা। ব্যালটের চেয়ে ইভিএম অধিকতর নিরাপদ ও সুরক্ষিত হলে বাকি ১৫০ আসনের নির্বাচন কি তাহলে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকত?
ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্তে বরফ বেশি গলেনি। মূল প্রশ্নটি রয়ে গেছে অমীমাংসিত। নির্বাচনের সময় সরকারের ভূমিকা কেমন হবে। সরকার আর রাষ্ট্র তো একাকার। সরকারের সঙ্গে আছে তার প্রশাসন। কোনো একটি ভোটকেন্দ্রে কেউ যদি ব্যালট বাক্স মাথায় নিয়ে দৌড় দেয়, নির্বাচন কমিশন তাকে কীভাবে ঠেকাবে? হ্যাঁ, টেলিফোনে কমিশনের জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধির পাঠানোর বার্তা দেখে কমিশন ঢাকায় বসে সিদ্ধান্ত নেবে।
ক্ষমতাসীন দল ও তার কতিপয় জোটসঙ্গী ইভিএমে নির্বাচন চেয়েছিল। কয়েকটি দল চায়নি। কমিশনের অবস্থান ছিল ক্ষমতাসীন দলের অনুরূপ। এখন কমিশন বলছে, নির্বাচন হবে পুরোনো পদ্ধতিতে, ব্যালট পেপার ব্যবহার করে। আমার মনে হয়, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কমিশন এটা মুখে না বললেও বোঝা যায়। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা গতকাল হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যায়নি।
কয়েক বছর ধরেই এ প্রবণতা দেখা গেছে। তা না হলে আমরা আইএমএফের কাছে ধরনা দেব কেন? সরকার বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে হয়। তবে সরকারের কেউ এটা বলবে না। নির্বাচন কমিশনও এটা স্বীকার করবে না। তা না হলে লোকে মনে করবে, কমিশন স্বাধীন নয়, সরকারের ইচ্ছায় চলে।
আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, ব্যালটে না ইভিএমে ভোট হলো, সেটা বিষয় নয়। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়াটাই মুখ্য বিষয়। বিশ্বে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ইসি প্রচলিত ব্যালটে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আগের অবস্থানে অনড় নয়। তারা চায় একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ যা চায়, অন্যান্য দলও তা-ই চায়। ভালো নির্বাচন কে না চায়! বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবি আমরা করে আসছি। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে, সেটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ইভিএম না ব্যালট—কোন মাধ্যমে ভোট হবে, সেটিকে আমরা গুরুত্ব দিতে চাই না।’ বিএনপির এ অবস্থান শুরু থেকেই ছিল। তাদের মাথাব্যথা নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে, ইভিএম নিয়ে নয়।
তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াল? নির্বাচনের মাঠে বড় খেলোয়াড় হলো আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। একটি দল মনে করে, বর্তমান সরকারের অধীন ভালো নির্বাচন সম্ভব। কারণ, নির্বাচন হবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীন। আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতা-কর্মীরা অবশ্য বলেই যাচ্ছেন, শেখ হাসিনার অধীনই নির্বাচন হবে।
বিএনপি অনেক দিন ধরেই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলে আসছে। তারা মনে করে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের খুব একটা সুবিধা হবে না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে গিয়ে তারা এটা ভালোভাবেই বুঝেছে। তারা দ্বিতীয়বার ‘আত্মহত্যা’ করতে রাজি হবে কি? সহজ অঙ্ক বলে, হবে না। তখন অন্য খেলা হতে পারে।
নির্বাচনের দেরি আছে আর মাত্র ৯ মাস। এই ৯ মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন হবে শুধু কৌশলের খেলা। সামনের দিনগুলোতে অনেক ঘটনা ঘটবে। চেনা-অচেনা অনেকেই মাঠে নেমে যাবে। কার হাতে কী অস্ত্র বা জাদু আছে, আমরা জানি না। এ ধরনের অনিশ্চিত অবস্থায় পূর্বাভাস দেওয়া যায় না।
ঘটনা ঘটে গেলে আমরা বিশ্লেষণ করতে বসি। যেমন ২০১৮ সালের নির্বাচনে আলাদিনের দৈত্য যে কী জাদু দেখাবে, তা বুঝতে দুদিন লেগেছে। আজকাল নির্বাচন ব্যালটে কিংবা ইভিএমে কতটুকু হয়, জানি না। আলাদিনের চেরাগটা কার হাতে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৮ সালটি আমাদের নির্বাচনের ইতিহাসে বিরাট একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে থাকবে।
ইভিএম বাদ দিয়ে ব্যালটে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্তে বরফ বেশি গলেনি। মূল প্রশ্নটি রয়ে গেছে অমীমাংসিত। নির্বাচনের সময় সরকারের ভূমিকা কেমন হবে। সরকার আর রাষ্ট্র তো একাকার। সরকারের সঙ্গে আছে তার প্রশাসন। কোনো একটি ভোটকেন্দ্রে কেউ যদি ব্যালট বাক্স মাথায় নিয়ে দৌড় দেয়, নির্বাচন কমিশন তাকে কীভাবে ঠেকাবে? হ্যাঁ, টেলিফোনে কমিশনের জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধির পাঠানোর বার্তা দেখে কমিশন ঢাকায় বসে সিদ্ধান্ত নেবে।
কিছুদিন আগে কমিশন ক্ষমতাসীন দলের পছন্দের প্রার্থীকে অবাক করে দিয়ে ভোট স্থগিত করে দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট হয় এবং কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয়, প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে সেটা দেখভালের দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনের।
এখানে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কিছু করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে এমন উদাহরণ নেই।
বেশ কিছুদিন ধরে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ছাড়িয়ে স্মার্ট বাংলাদেশে উড়ে বেড়াবার কথা বলছি। ডিজিটাল সিস্টেমের ইভিএম গেল। এবার কি আমরা তবে ‘স্মার্ট ইলেকশন’ দেখব?
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক