২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন। এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন। তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ পাসের হার ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। আগের বছরের চেয়ে পাসের হার বেড়েছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ কমেছে ১ হাজার ৪৪৯। এসব পরিসংখ্যান শিক্ষার কোনো মান নির্দেশ করে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
আমাদের দেশে শিক্ষার মানের কতটুকু উন্নতি ঘটল, এটা বোঝাতে সাধারণভাবে পাসের হারকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পাসের হার যে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না তার প্রমাণ এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতা। প্রতিবছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করে। অথচ এসব পাস করা শিক্ষার্থীর শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর তুলতে পারে না।
শিক্ষার মানের কতটুকু উন্নতি ঘটল, এটা বোঝাতে সাধারণভাবে পাসের হারকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পাসের হার যে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না, তার প্রমাণ এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতা
এখন শিক্ষা মানে জিপিএ-নির্দেশক একটি সার্টিফিকেট। সেটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কতটা সুবিধা দেবে কিংবা চাকরির বাজারে কতটা এগিয়ে রাখবে, এটা নিয়েই ভাবনা সবার। জিপিএ-৫ নিশ্চিত করার জন্য অভিভাবকেরা সবকিছু করতে প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু এই জিপিএ ও নম্বর শিক্ষার্থীর দক্ষতা বা পারদর্শিতা যথাযথভাবে নির্দেশ করে না। আর কৃতকার্য–অকৃতকার্যের হার দেখে কিংবা আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করে শিক্ষার অগ্রগতি-উন্নতি নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়।
ভালো শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে দেয় এবং জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার কোন পর্যায়ে শিক্ষার্থী কতটুকু দক্ষতা অর্জন করবে, তা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করা থাকে। ভালো শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের রূপ বা ধরন বদলে নিতে পারে। পুরো প্রক্রিয়াটি হয় শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক এবং তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক। শিক্ষা গ্রহণের জন্য নানা রকম উপাদান ও উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ থাকে। বারবার অনুশীলন ও পরীক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগের সক্ষমতা নিশ্চিত করা হয়। শিক্ষার্থীকে যাচাই ও মূল্যায়ন করার জন্য বৈচিত্র্যময় উপায় থাকে। অর্জিত শিক্ষা শিক্ষার্থীর মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। তা ছাড়া ভালো শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংযোগ তৈরি হয়।
কোনো ধরনের শিক্ষায়ই নম্বর বা জিপিএ–প্রধান হতে পারে না; বরং শিক্ষার্থীর দক্ষতা অর্জনের দিকটি প্রধান। দক্ষতা অর্জনকে গুরুত্ব দিয়েই শিক্ষাকাঠামো পরিচালিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিটি শ্রেণির একেকটি বিষয়ের জন্য যোগ্যতা বা দক্ষতা নির্দিষ্ট করা আছে। এসব দক্ষতা অর্জন করা সাপেক্ষে শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করানোর কথা। কিন্তু আমাদের দেশের মূল্যায়ন বা পরীক্ষাপদ্ধতি নম্বর ও জিপিএ-ভিত্তিক হওয়ায় শিক্ষার্থীর দুর্বলতার ক্ষেত্রগুলো শনাক্ত করা যায় না। আর শনাক্ত করা যায় না বলে বিভিন্ন পারদর্শিতায় দুর্বল থেকেই তারা পরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। এ সমস্যা কাটানোর ভালো উপায় হতে পারে পরীক্ষাপদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করা এবং মূল্যায়নের ধরনে বদল আনা।
বর্তমান পদ্ধতিতে নম্বরপত্রে দেখানো হয়, একজন শিক্ষার্থী বাংলায় ৭৮ নম্বর এবং এ গ্রেড পেয়েছে। শিক্ষার্থীর এই নম্বর ও গ্রেড তার বাংলা বিষয়ের সক্ষমতার দিক বা ক্ষেত্র চিহ্নিত করে না। অথচ মূল্যায়নপত্রে বাংলা বিষয়ের ঘরে দেখানো দরকার ছিল, শিক্ষার্থী ভাষা-যোগাযোগে কতটুকু পারঙ্গম, বিবরণমূলক ও বিশ্লেষণমূলক লেখা কেমন লিখতে পারে, ভাষার ব্যাকরণ কতটুকু প্রয়োগ করতে পারে, তার সাহিত্যের বোধ ও সাহিত্য-পর্যালোচনার সক্ষমতা কেমন।
পরীক্ষায় এখনকার মতো কেবল গতানুগতিক ধারায় প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিয়ে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিষয়গত দক্ষতা যাচাই করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমাদের দেশে এখনো শিক্ষার্থীর নম্বর কম-বেশি হয় প্রশ্ন ‘কমন-আনকমনের’ কারণে! এবার কত ভাগ প্রশ্ন ‘কমন ফেলা’ সম্ভব হয়েছে, গাইড বই আর কোচিং সেন্টারগুলো সদর্প সেই সংখ্যা তুলে ধরে।
আসলে, সাজেশন দিয়ে আর নোট-গাইড সরবরাহ করে শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করানো শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে না। এই প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে দেশে শিক্ষা বলে কিছু থাকবে না। এই সংবাদও অনেকের নজরে পড়েছে যে এ বছর ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। এর অর্থ কি এই যে এসব প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী নবম শ্রেণি পর্যন্ত সব যোগ্যতা ও পারদর্শিতা অর্জন করে দশম শ্রেণিতে উঠেছে, কিন্তু দশম শ্রেণিতে কোনো পড়াশোনা করেনি? ব্যাপারটি আসলে তা নয়। মূল ব্যাপার হলো, বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতি ও মূল্যায়নপ্রক্রিয়ায় দক্ষতা বা পারদর্শিতা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। ফলে নম্বরের অস্পষ্ট ধারণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে নতুন শ্রেণিতে ওঠানো হয়।
ফলাফল নিয়ে আরেকটি কথা, প্রতিবার এসএসসি পরীক্ষার ‘কৃতকার্য-অকৃতকার্য’ হিসাব করা হয়। কিন্তু উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয় না কিংবা পরবর্তী দুই বছর আর পড়াশোনা চালাতে পারে না। এসব শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার কারণ নিয়েও ভাবতে হবে। দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিক্ষার্থী জীবনের এ পর্যায়ে বিভিন্ন পেশায় ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়। পেশাগত জীবনেও তারা দশম শ্রেণির নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারে না।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক