মাসখানেক আগে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন দৈনিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি সংবাদ ছাপা হয়। সেখানে একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলা হয়, তৃতীয় শ্রেণির ৭৬ ও চতুর্থ শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিকমতো বাংলা পড়তে পারছে না।
এর আগেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হলেও তাদের সবার ঠিকমতো পড়ার দক্ষতা তৈরি হয় না। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি জরিপেও দেখানো হয়েছিল, প্রাথমিকের মাত্র ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে।
বাংলা পড়তে না পারা বলতে কী বোঝানো হয়? পড়তে না পারা বলতে বোঝানো হয় নির্ধারিত গতির চেয়ে ধীরে পড়া, প্রচুর ভুল পড়া এবং পড়ে বুঝতে না পারা। শিক্ষার্থীর পড়ার দক্ষতা যাচাই করার ভালো উপায় হলো শ্রেণি-উপযোগী কোনো পাঠ থেকে এক বা একাধিক অনুচ্ছেদ জোরে জোরে পড়তে দেওয়া। পড়ার গতি ও ধরন দেখেই বোঝা যাবে তার পড়ার দক্ষতা তৈরি হয়েছে কি না।
যে শিক্ষার্থী বুঝে পড়ে, সে যথাযথ অভিব্যক্তি দিয়ে পড়তে পারে। পড়ার পর পাঠটির ওপর কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমেও নিশ্চিত হওয়া যায়, শিক্ষার্থী বিষয়টি বুঝে পড়েছে কি না। কারণ, পড়তে পারা মানে কেবল পড়ে যাওয়া নয়।
শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে না পারলে অন্য বিষয়গুলোতেও এর প্রভাব পড়ে। তাই প্রাথমিকে বাংলা পড়ানোর প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া দরকার ভাষা শেখানো। কীভাবে দ্রুত মাতৃভাষা পড়তে ও লিখতে শেখানো যায়, তা নিয়ে প্রতিবছরই নতুন নতুন গবেষণা প্রকাশিত হচ্ছে। মাতৃভাষা আর দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা শেখানোর পদ্ধতি এক নয়। তা ছাড়া বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আরেক সমস্যা তৈরি করে কারচিহ্ন, ফলাচিহ্ন এবং যুক্তবর্ণ। এগুলো থাকার কারণে বাংলা পড়ার গতি এমনিতেই কম হয়।
পড়ার দক্ষতা ও আগ্রহ বাড়ানো নিয়ে এ দেশে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মিনিটে মাত্র ১৬টি শব্দ পড়তে পারে আর দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পারে ৩৩টি শব্দ।
এসব শব্দের বেশির ভাগই হতে হবে শিক্ষার্থীর পরিচিত জগতের এবং দৈনন্দিন কথোপকথনে ব্যবহৃত। অথচ আমাদের প্রাথমিক শ্রেণির কোনো বইয়ে শব্দসীমার এই নিয়ন্ত্রণ দেখা যায় না। যেমন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির একেকটি বইয়ে ১৫ থেকে ২০ শব্দের অসংখ্য বাক্য দেখা যায়। কতভাগ অপরিচিত ও নতুন শব্দ ব্যবহার করা যাবে, তারও কোনো আনুপাতিক বিবেচনা নেই।
তাদের মতে, পাঠের বিষয় বুঝতে একজন শিক্ষার্থীর পড়ার হার হওয়া দরকার মিনিটে কমপক্ষে ৪৫ থেকে ৬০। গবেষণাটি আরও বলছে, প্রথম শ্রেণির ৩২ শতাংশ এবং দ্বিতীয় শ্রেণির ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী একটি বাংলা শব্দও পড়তে পারে না।
প্রাথমিকের বাংলা বইয়ে পাঠ বাছাই বা রচনার সময় এবং সেখান থেকে প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে পাঠের বিষয় ও বক্তব্যকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ সেখানে ভাষা শেখা ও প্রয়োগের কাজটি প্রাধান্য পাওয়া উচিত ছিল।
প্রথম শ্রেণির পরে মনে করা হয়, শিক্ষার্থী এখন বাংলা পড়তে শিখে গেছে। অতএব দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ভাষা শেখার বিশেষ কোনো কাজ দেওয়া হয় না। এমনকি, বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ের বাক্যে কতটি করে শব্দ থাকতে পারে, শিক্ষাক্রমে তার কোনো নির্দেশনাও নেই।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে বাক্যে শব্দসংখ্যার একটি ধারণা দেওয়া যেতে পারে। যেমন প্রথম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের প্রতি বাক্যে ১ থেকে ৩টি শব্দ থাকতে পারে। দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ে বাক্যে শব্দ থাকবে ১ থেকে ৫টি। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে এই শব্দসংখ্যা হতে পারে সর্বোচ্চ ৮, ১০ ও ১৫।
এসব শব্দের বেশির ভাগই হতে হবে শিক্ষার্থীর পরিচিত জগতের এবং দৈনন্দিন কথোপকথনে ব্যবহৃত। অথচ আমাদের প্রাথমিক শ্রেণির কোনো বইয়ে শব্দসীমার এই নিয়ন্ত্রণ দেখা যায় না। যেমন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির একেকটি বইয়ে ১৫ থেকে ২০ শব্দের অসংখ্য বাক্য দেখা যায়। কতভাগ অপরিচিত ও নতুন শব্দ ব্যবহার করা যাবে, তারও কোনো আনুপাতিক বিবেচনা নেই।
শিক্ষার্থীর পড়ার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদেরও ভূমিকা রয়েছে। বছর পাঁচেক আগে ইউনেসকোর এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার সবচেয়ে কম। শিক্ষকেরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পান না। এ নিয়ে শিক্ষকদেরও আক্ষেপ আছে।
তাদের আরেকটি অভিযোগ, একটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। তাই তাঁদের পক্ষে আলাদাভাবে সব শিক্ষার্থীর দিকে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। বাড়ির কাজ করতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী পরিবার থেকেও সহায়তা পায় না। কারণ, তাদের মা-বাবা নিরক্ষর। ফলে দেখা যায়, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীকেও অভিভাবকেরা কোচিং করান বা প্রাইভেট পড়ান।
অভিভাবকদের মধ্যে এই ধারণা রয়েছে, বইয়ের প্রশ্নের উত্তর শিক্ষক লিখে দিলে তাঁর সন্তান ভালো নম্বর পাবে। ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের চারজনই শিক্ষকের তৈরি করে দেওয়া নোট বা বাজারের গাইড ব্যবহার করে।
শিক্ষার্থীর দক্ষতা অর্জিত হলো কি না, এই নিয়ে মা-বাবা, এমনকি শিক্ষকেরাও বিশেষ মনোযোগী নন। অথচ শিক্ষকদের কাজ ছিল শিক্ষার্থীর শিখন-ঘাটতি বা শিখন-দুর্বলতা শনাক্ত করা। এরপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।
এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার অর্থ হলো, ওই শিক্ষার্থী তার আগের শ্রেণির দক্ষতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে দক্ষতা বিবেচনায় না নিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে শিক্ষার্থীকে ওঠানো নিয়েই চিন্তা থাকে সবার।
করোনাকালেও শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওই সময় যেসব শিক্ষার্থী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল, তাদের একটা বড় অংশ এখনো ঠিকমতো পড়তে পারে না।
তা ছাড়া ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নিশ্চিত করতে গিয়ে সরকার কেবল ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিকে তাকিয়েছে, শিক্ষার্থীর শিখন কতটা অর্জিত হলো, তার দিকে তাকায়নি। এর ফল হিসেবে বাংলা পড়তে না পারার মতো প্রতিবেদন ও সংবাদ দেখা যায়।
আরেকটি বিষয় বলে রাখতে হয়। আমাদের দেশে শিক্ষাকে ‘সস্তা’ করার একটা প্রবণতা আছে। শিক্ষার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত থাকেন, তাঁদের কত কম টাকা দেওয়া যায়, এটাই যেন বিবেচনায় থাকে। এশিয়ার মধ্যে যেসব দেশে জিডিপির হিসাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগের হার একেবারে তলানিতে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আমাদের বাজেটে শিক্ষা খাতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক