পাহাড়ে বিপর্যয়ের পদধ্বনি

‘পাহাড়ে শুধু হাজার কিলোমিটার সীমান্তসড়ক নির্মাণ করলেই উন্নয়ন হবে না, এই উন্নয়নের সঙ্গে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে, তাদের মৌলিক চাহিদাগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।'
ফাইল ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, তন্মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিক্য ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশ ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশে পড়তে শুরু করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু যে মানব উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তা কিন্তু নয়। প্রকৃতির এ পরিবর্তন মানবনিরাপত্তার ওপরও বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে।

কয়েক বছর ধরে পাহাড়ে খাবার পানি ও খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জুম পাহাড়ের মানুষেরা তাদের নিত্যব্যবহার্য ও খাওয়ার পানির জন্য মূলত পাহাড়ের ঝিরি, খালের ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু পাহাড়ে ব্যাপক হারে বন উজাড় করার পাশাপাশি বর্তমানে কিছু মুনাফালোভী স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড়ের ঝিরি ও নদী থেকে অবাধে পাথর উত্তোলনের ফলে পাহাড়ের পানির উৎসগুলো একে একে শুকিয়ে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি ও পানির উৎস না থাকায় বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক পাহাড়ি বসতি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এ নীরব বাস্তুচ্যুতির ফলে পাহাড়ে আরেক নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।

আমরা কেবল বিভিন্ন উন্নয়নের কথা শুনি। কিন্তু সেই উন্নয়নের হিসাবের খাতায় যেন প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনোমতে টিকে থাকা সাজেক, রেমাক্রির মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাহাড়ে শুধু হাজার কিলোমিটার সীমান্তসড়ক নির্মাণ করলেই উন্নয়ন হবে না, এই উন্নয়নের সঙ্গে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে, তাদের মৌলিক চাহিদাগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি বিরাট বিপর্যয় হলো, পাহাড়ে ঘন ঘন ইঁদুর–বন্যাসহ পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গের উৎপাত বেড়ে যাওয়া। এ উৎপাতের ফলে প্রতিবছর পাহাড়ি জুম ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং সেখানে নীরব দুর্ভিক্ষ দেখা দিচ্ছে। আমরা ২০১২ সালে পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক ইঁদুর–বন্যার কথা জানি।

সে সময় বান্দরবানের থানচি, রুমা, রাঙামাটির সাজেক, বিলাইছড়ি, জুরাছড়িসহ ব্যাপক এলাকায় ভয়াবহ ইঁদুর–বন্যা দেখা দেয় এবং সেসব এলাকায় চরম খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। ২০১৬ সালেও ইঁদুর–বন্যার কারণে বান্দরবানে থানচির দুর্গম এলাকার জুমিয়ারা চরম খাদ্যসংকটে পড়েছিলেন।

‘ইঁদুর–বন্যা’ কী? এ বিষয়ে একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। স্থানীয় লোকজন জানান, প্রতি ৫০ বছর অন্তর মুলিবাঁশে মড়ক লাগে। সে সময় এ প্রজাতির বাঁশে ফুল ও ফল আসে এবং পরে বাঁশগুলো মরে যায়। মড়ক লাগা এ বাঁশের ফুল-ফল খেলে ইঁদুরের প্রজননক্ষমতা বেড়ে যায়, তখনই ইঁদুর–বন্যা দেখা দেয়।

সম্প্রতি সাজেক এলাকার অধিবাসীরা জানান, বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও সাজেক এলাকায় খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে। কারণ, গত বছর ওই এলাকায় শুধু মুলিবাঁশে নয়, দুলু বাঁশ, মিতিঙ্গা বাঁশ ও ফারুয়া বাঁশেও মড়ক লেগেছে। তাই এ বছর শুধু ইঁদুরই নয়, কাঠবিড়ালি, বনমোরগের প্রজননও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এসব বন্য প্রাণীর উৎপাতের ফলে গত বছর জুমচাষিরা জুম থেকে আশানুরূপ ফসল তুলতে পারেননি।

এ সংকট শুধু সাজেক এলাকায় নয়, বান্দরবানের থানচি, রুমা, লামা এলাকার জুমিয়ারাও খাদ্যসংকটের হুমকির মধ্যে রয়েছেন (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন)। একদিকে অনাবৃষ্টির কারণে ভালো ফলন না হওয়া, অন্যদিকে ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, বনমোরগের উৎপাতে জুমিয়ারা ঘরে যে যৎসামান্য খাদ্য মজুত করতে পেরেছেন, সেগুলোও সংরক্ষণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

২.

আমরা জানি, বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেকের মতে, বাংলাদেশ এসজিডি বাস্তবায়নে আগের চেয়ে এগিয়ে আছে। যদিও কোভিডের দুই বছরে এ কার্যক্রম কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে।

এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে দুটি অন্যতম লক্ষ্য হলো, দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা এবং কোনো মানুষ অভুক্ত থাকবে না। এ ছাড়া এসডিজির চার নম্বরে বলা হয়েছে, সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ ও শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, সাজেক ইউনিয়নের বেটলিং মৌজার শিশুরা কিংবা থানচির দুর্গম এলাকার রেমাক্রি, ছোট মদক, বড় মদকের পাহাড়ি শিশুরা কি এসডিজির এ গুণগত শিক্ষার সমান সুযোগ পাচ্ছে?

তাই এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে পাহাড়ের সাজেক, থানচি, লামা, রেমাক্রির জুমিয়ারা যে অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, এ সংকট মোকাবিলায় সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটা জানা আমাদের বেশি জরুরি।

এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, সে উদ্যোগকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। তবে দেশের বৃহৎ একটা অংশকে পেছনে রেখে যে লক্ষ্যই অর্জন করা হোক না কেন, সেটা টেকসই হবে না। তাই দেশের সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাজেক কিংবা রেমাক্রির সৌন্দর্য উপভোগ করতে যাওয়ার আগে সেখানকার শিশুদের মুখে খাবার ও শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা কেবল বিভিন্ন উন্নয়নের কথা শুনি। কিন্তু সেই উন্নয়নের হিসাবের খাতায় যেন প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনোমতে টিকে থাকা সাজেক, রেমাক্রির মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাহাড়ে শুধু হাজার কিলোমিটার সীমান্তসড়ক নির্মাণ করলেই উন্নয়ন হবে না, এই উন্নয়নের সঙ্গে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে, তাদের মৌলিক চাহিদাগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সবার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ মধুপুর, সিলেট অঞ্চলে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়ন প্রকল্প গ্রহণের প্রক্রিয়া, পর্যটনের নামে ভূমি অধিগ্রহণ ও সরকারি অবকাঠামো স্থাপন বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানিসহ বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক অনুন্নয়ন খাতে কৃষিজমি ব্যবহারের জন্য হাজার হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ ও ইজারা নেওয়ার প্রক্রিয়াও বন্ধ করতে হবে।

এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় লোকজনকে সম্পৃক্ত করে তাদের প্রচলিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। তবেই পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ টেকসই ও সাশ্রয়ী হবে।

  • ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেনস ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক