কেন এই লাগামহীন অর্থপাচার

যুক্তরাষ্ট্রের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্ট কিংবা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর রিপোর্ট থেকে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে পুঁজি পাচার সম্পর্কে আমাদের বেশ ধারণা হয়েছে। যদিও কত টাকা দেশ থেকে সরাসরি পাচার হয়েছে বা মোটা অঙ্কের টাকা কীভাবে পাচার হয়, সেই সম্পর্কে আমাদের কোনো গভীর গবেষণা নেই। তবু বিভিন্ন সূত্রমতে ব্যাপক সরকারি দুর্নীতি, অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থা, বিশেষ করে নির্বাচনের বছরেই বেশি পুঁজি পাচার হয় বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা। সেই সঙ্গে পেছনের মূল কারণ হিসেবে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় স্বজনতোষী পুঁজিবাদকেই বেশি দায়ী করা হয়ে থাকে। পদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনির্ভর পুঁজি পাচারকেই সাধারণত কাঠগড়ায় তোলা হয়।

অন্যদিকে আমরা দেখেছি, বছর দেড়েক ধরেই আমাদের দেশের অর্থনীতি নানা সংকটে পড়েছে। মূল্যস্ফীতির ভয়াল প্রভাবে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্ন আয়ের মানুষের। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত সেপ্টেম্বরেও দুই বিলিয়ন ডলার কমেছে রিজার্ভ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ পেতে বেশ কিছু শর্ত মেনে চলতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এরই মধ্যে নীতি সুদহার ও ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মাসে রেমিট্যান্সপ্রাপ্তিও ছিল ৪১ মাসের সর্বনিম্ন। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন আরও কমছে। অর্থবাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশ থেকে অর্থ পাচার বেপরোয়া হওয়ার কারণেই বিদেশে হুন্ডির চাহিদা বাড়ছে। নির্ধারিত হারে ডলার লেনদেনের চেয়ে কালোবাজারে অতিরিক্ত মূল্যে ডলার বিক্রি করছেন প্রবাসীরা। অনেক পরিসংখ্যানই বলছে, প্রবাসে শ্রমিক যে হারে গেছেন, তার সঙ্গে তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সংগতি পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত হুন্ডি-হাওলার মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলেই বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।

আমরা প্রায় সবাই জানি, রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে চাইলে দেশ থেকে অবৈধ অর্থ পাচার বন্ধ করা অতীব জরুরি। অথচ অর্থনীতির এই চিহ্নিত ক্ষত নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) ঘাটতি ছিল ৬৬৫ কোটি ডলারের বেশি। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) শেষে তা ৮২২ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এ ঘাটতি হিসাবের সময় ভুলভাবে উপস্থাপিত, একপক্ষীয় বা বাদ পড়া লেনদেনের (নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনস বা এনইও) তথ্য সমন্বয় করতে হয়েছে ৩২২ কোটি ডলারের (ঋণাত্মক), যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট বিওপি ঘাটতির ৩৯ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও (জুলাই-আগস্ট) লেনদেনের ঘাটতির প্রায় ৪৭ শতাংশই ছিল এররস অ্যান্ড ওমিশনসজনিত।

গত অর্থবছর শেষে এই ঘাটতি দাঁড়ায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এ ঘাটতির বড় অংশজুড়ে রয়েছে এররস অ্যান্ড ওমিশনস। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের ভাষ্যমতে, বৈদেশিক লেনদেনের আন্ত ও বহিঃপ্রবাহের হিসাবের সঙ্গে প্রকৃত ব্যালান্সের যে পার্থক্য পাওয়া যায়, সেটিকেই নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। দীর্ঘ সময় এই ভুল বা বাদ পড়ে যাওয়ার অঙ্কটি ঋণাত্মক অঙ্কে থাকলে এটিকে চিহ্নিত করা হয় সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পুঁজি বের হয়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবে। আইএমএফের কমিটি অন ব্যালান্স অব পেমেন্ট স্ট্যাটিসটিকসের ৩২তম বৈঠকে উপস্থাপিত নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনস-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, এটি ঋণাত্মক পর্যায়ে নেমে আসার অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে সম্পদ বের হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও নিট এররস অ্যান্ড ওমিশনসের অঙ্কটি দীর্ঘদিন ধরেই ঋণাত্মক পর্যায়ে অবস্থান করছে। মোট লেনদেনের ভারসাম্যে এর অংশটিও অনেক বড়। সে হিসেবে বলা চলে, দেশে লেনদেনের ঘাটতির বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে ভুল বা বাদ পড়া লেনদেনের অঙ্ক, যার বড় একটি অংশের কোনো হদিস কারও কাছে নেই। ভুল বা বাদ পড়ে যাওয়ার এ পরিসংখ্যানকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন এ বিষয়ে জ্ঞাত প্রায় সবাই।

সন্দেহ নেই, পুঁজি পাচারে যেকোনো দেশের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হয়। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রা যেকোনো উদীয়মান দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পাওনা শোধ করা হয়। দেশের অর্থনীতির মুদ্রার মান নির্ণিত হয়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রিত থাকে। অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশ ও সরকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার রিজার্ভ হ্রাস পায়। এতে দেশ সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়।

দ্বিতীয়ত, দেশীয় টাকা অর্থ পাচারের মাধ্যমে বিদেশে চলে যায়। এ টাকা দেশে থাকলে তা বিনিয়োগ ও ভোগে ব্যবহৃত হতো, কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নে ভূমিকা রাখত। সুতরাং এতে দেশ ও জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে।

তৃতীয়ত, অর্থ পাচারের পেছনে উপার্জনের মাধ্যম হয়ে থাকে সাধারণত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সেটি হতে পারে অবৈধ পণ্য দিয়ে, হতে পারে সন্ত্রাসী বা অবৈধ কোনো উদ্দেশ্যে অর্থ পাচার করা। সুতরাং এসবও দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। চতুর্থত, অর্থ পাচারের মাধ্যমে সরকার রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হয়। তা ছাড়া এতে পণ্যটি দেশের জন্য কতটুকু উপকারী, তা-ও যাচাই করার সুযোগ থাকে না। মোদ্দা কথায়, পুঁজি পাচার একটি দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়।

কেন এ অর্থ পাচারের ঘটনা লাগামহীন চলছে? অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা ও পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় প্রতিবছর দেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, একটি গোষ্ঠী বন্ডেড ওয়্যারহাউসের অপব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মূল্য অতিরঞ্জিত করে খুব সহজেই বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক বনে যাচ্ছেন। এ ছাড়া নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ পন্থায় প্রভাবশালীরা খুব সহজেই অবৈধ পথে আয় করছেন, যা পরবর্তী সময়ে কালোটাকা বলে পরিগণিত হয়। এ টাকা করবহির্ভূত হওয়ায় বৈধভাবে বিনিয়োগও করতে পারেন না। ফলে তা বিভিন্নভাবে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে।

এ অবস্থায় অর্থ পাচার ঠেকাতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্য আমদানি-রপ্তানিসহ সামগ্রিক আর্থিক খাতে স্বচ্ছ-জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তবে সবার আগে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকালে রপ্তানিকারকদের বিদেশে রপ্তানি আয় রেখে দেওয়ার পরিমাণ সীমিত করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয় দেশে আনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যৌথভাবে কমিটি গঠন করে দ্রব্যের আমদানি ও রপ্তানি মূল্য যাচাই করে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধে দুদক ও সিআইডিকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

সরকার দেশে অর্থ পাচার নিরোধ বা বন্ধের জন্য বেশ আগেই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইন অনুযায়ী, বৈধ অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে অর্থ-সম্পত্তি প্রেরণ বা পাচার কিংবা দেশের বাইরে উপার্জিত সম্পত্তি, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে, তা ফেরত না আনা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে অর্জিত অর্থ বা প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে থেমে নেই অর্থ পাচার।

জনসাধারণের অনেকের মতেই, দেশের সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে এ ধরনের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করে দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে দীর্ঘকালীন পুঁজি পাচার ঠেকাতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিংবা গবেষকদের অনেকেই করব্যবস্থা সহজীকরণ এবং করহার হ্রাসের ওপর অনেক জোর দিয়েছেন। এমনকি বাণিজ্যবিধি ঢেলে সাজানোসহ সামগ্রিক আইনি ও বিনিয়োগ কাঠামোয় সংস্কারের কথাও বলেছেন।

  • মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক