ইমরান খানের গ্রেপ্তার অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিল

পর্দার আড়ালের যে ঘটনার কারণেই ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হোক না কেন, এর রাজনৈতিক দায় অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে।
ফাইল ছবি: এএফপি

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশটির বিরোধী দল পিটিআইয়ের (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ) নেতা ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের খবর ইতিমধ্যে বিশ্বসংবাদে পরিণত হয়ে গেছে। এটা যতটা শরিফ ও ভুট্টো ডাইনেস্টির ইচ্ছায় ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি সেনাবাহিনীর চাপে ঘটল।

ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে ইমরান পুনঃপুন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছিলেন। বিশেষ করে তাঁকে হত্যাচেষ্টার জন্য দেশটির প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ ছিল। সাবেক সেনাপ্রধানকেও তিনি বহুবার রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য দোষারোপ করেছেন।

আইএসআইয়ের বিরুদ্ধে ইমরানের লাগাতার অভিযোগে এ সংস্থার কর্মকর্তারা এক বছর ধরে ত্যক্তবিরক্ত ছিলেন। সর্বশেষ গতকালও তিনি জেনারেল ফয়সাল নাসির নামের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁকে দুই দফায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করেন। অভিযোগ উত্থাপনের খুব আক্রমণাত্মক এবং আইএসপিআর তার জবাব দিয়েছে ততোধিক কড়া ভাষায়। ইমরান আবার আদালতে যাওয়ার পথে গাড়িতে বসে এক ভিডিওর মাধ্যমে সেনা জনসংযোগ বিভাগের অভিযোগের উত্তর দিয়েছেন। এ রকম পাল্টাপাল্টির মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছিল উভয় পক্ষ লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করতে চলেছে।

আজ ইসলামাবাদ হাইকোর্ট থেকে তাঁকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেল, ইমরানের ব্যাপারে সেনাবাহিনী মনস্থির করে ফেলেছে—যদিও প্রকাশ্যে পুলিশ বিভাগ বলেছে, ভূমিসংক্রান্ত একটা পুরোনো দুর্নীতির মামলায় তাঁকে আটক করা হলো।

বন্দিত্ব ইমরানের জনপ্রিয়তা আরও বাড়াবে

পর্দার আড়ালের যে ঘটনার কারণেই ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হোক না কেন, এর রাজনৈতিক দায় অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন শরিফ বংশকে। ইমরান ইতিমধ্যে জনপ্রিয় নেতা এবং বন্দিত্ব তাঁকে আরও জনপ্রিয় করবে। তাঁকে যেভাবে ধাক্কাধাক্কি করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তার যেসব ভিডিও ইতিমধ্যে টুইটারে এসেছে সেগুলো নিশ্চিতভাবে সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাবে। কোনো কোনো রাজনৈতিক ভাষ্যকার ইমরানের আটকের ধরনকে ‘অপহরণ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ইমরানের শাসনামলের ব্যর্থতাগুলোকে জনগণ এখন আর গুরুত্ব দেবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে এ রকম জনপ্রিয়তা কারও ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করবে, এমন নিশ্চয়তা পাকিস্তানে অন্তত দেওয়া যায় না।

ইমরানকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করতে শরিফদের আগ্রহ পুরোনো। কিন্তু সাবেক এই ক্রিকেটারের দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তায় তাঁকে চট করে আটকের উপায় ছিল না। সেনাবাহিনীও এ বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। ইমরানের পুনঃপুন উসকানিতে দেশটির ‘ডিপ স্টেটে’র সেই দোদুল্যমানতা কেটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এই আটক পরিস্থিতি সহজ করার পরিবর্তে আরও জটিল করছে বলেই মনে হয়।

শরিফ সরকারকে রাজপথে বিক্ষোভ মোকাবিলা করতে হবে

ইমরানের নির্বাচনের দাবি এবং তার সপক্ষে সর্বোচ্চ আদালতের অবস্থান গ্রহণে সরকার দুই-তিন মাস ধরে বেকায়দায় ছিল। নির্বাচনের সময় ও ধরন নিয়ে দেশটির বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মাঝে রীতিমতো সাপে-বেজিতে যুদ্ধ চলছিল। আজ ইমরান খানের আটকের ভেতর দিয়ে সেই যুদ্ধও নতুন মোড় নেবে। কারণ, পিটিআইয়ের কর্মীরা এখন তাঁদের সপক্ষে কিছু করার জন্য আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকবেন।

ইমরানের দলের কর্মীরা প্রতিবাদে রাজপথে কতটা শামিল হবেন, সেটাও আগামী কয়েক ঘণ্টায় নজর রাখার ব্যাপার হবে। ইতিমধ্যে ইসলামাবাদে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, রাজপথে যেকোনো প্রতিবাদকে প্রশাসন শক্তভাবে মোকাবিলা করবে। তাতে অবশ্য দেশটির চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের তেমন কোনো সুরাহা হবে না। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য ইমরানের দলের সঙ্গে সরকারের যে আলোচনা চলছিল নিশ্চিতভাবে বলা যায় তার আর কোনো ভবিষ্যৎ রইল না আজকের ঘটনায়।

এটাকে কি ছদ্ম সেনাশাসন বলা হবে?

পাকিস্তানে সেনাশাসনের ইতিহাসের বেশ সমৃদ্ধ ও পুরোনো। ১৯৫৮ সাল থেকে এটা শুরু হয়। আজকে ইমরানের আটকের ভেতর দিয়ে যে অধ্যায় শুরু হলো, ‍তাকে একধরনের ছদ্ম সেনাশাসন হিসেবে উল্লেখ করা হবে কি না, সে বিষয়ে অবশ্যই ব্যাপক ভিন্নমত থাকবে। তবে সেনাবাহিনীর পূর্ণ সম্মতি ও আগ্রহ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতেন না।

ইমরানের আটক পরিস্থিতি আরও জটিল করতে পারে

ইমরানকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করতে শরিফদের আগ্রহ পুরোনো। কিন্তু সাবেক এই ক্রিকেটারের দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তায় তাঁকে চট করে আটকের উপায় ছিল না। সেনাবাহিনীও এ বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। ইমরানের পুনঃপুন উসকানিতে দেশটির ‘ডিপ স্টেটে’র সেই দোদুল্যমানতা কেটে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এই আটক পরিস্থিতি সহজ করার পরিবর্তে আরও জটিল করছে বলেই মনে হয়। প্রশ্ন উঠেছে, সেনাবাহিনী ও সরকার এখন কী করবে? তারা কি পিটিআইয়ের চাওয়ামতো এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশমতো পাঞ্জাবে এবং পরবর্তীকালে জাতীয় নির্বাচন দেবে?

নিশ্চিতভাবে এ বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদি নির্বাচন দেওয়া হয় তাহলে সেই নির্বাচন কি সুষ্ঠুভাবে হতে দেওয়া হবে? এ প্রশ্নের সঙ্গে সম্পূরক আরও দুটি প্রশ্ন চলে আসে—সুষ্ঠু যেকোনো নির্বাচনে পিটিআই জিতে এলে সেনাবাহিনী তখন ইমরান খানকে নিয়ে কী করবে? আর যদি সম্ভাব্য নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হয় তাহলে প্রতিবাদী ইমরান-ভক্তদের রাজপথে সামাল দিতে দেশটির বর্তমান সরকার কতটা সক্ষম? তা ছাড়া সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে উচ্চ আদালতের মুখ কীভাবে বন্ধ রাখবে ডিপ স্টেট?

এ রকম একটা অস্থির অবস্থায় পাকিস্তানকে আইএমএফ আদৌ ঋণ দিতে রাজি হবে কি না, সেটাও একটা গভীর ভাবনার বিষয়। আইএমএফের ‘অক্সিজেন’ ছাড়া আগামী জুন থেকে দেশটির দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও আছে!

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক