মতামত

সেই ‘রাজনৈতিক তালাশে’ আটকে গেল বিসিএসের গেজেট?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান ও স্নাতকোত্তর দুটি পরীক্ষায়ই প্রথম হয়েছিলেন তিনি। এরপর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন প্রশাসন ক্যাডারে। কিন্তু একটি গোয়েন্দা সংস্থার নেতিবাচক প্রতিবেদনে আটকে যায় তাঁর গেজেট। এরপর পুনরায় প্রজ্ঞাপনের জন্য আবেদন করে মাসের পর মাস তিনি ঘুরতে থাকেন সরকারের নানা দপ্তরে। কিন্তু নিয়োগ পাননি।

বিসিএসের ২৮তম ব্যাচ থেকে ৪২তম ব্যাচ পর্যন্ত অন্তত ২৬৫ জন প্রার্থীর নিয়োগ এভাবে আটকে ছিল। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কারণ দেখিয়ে তাঁদের নিয়োগ দেয়নি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট তাঁদের সবার নিয়োগের গেজেট হয়েছে। দীর্ঘ হতাশার পর তাঁরা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।

বছরের পর বছর আটকে থাকার পর এই প্রার্থীরা নিয়োগ পেয়ে আনন্দিত। কিন্তু ফল প্রকাশের নয় মাস পরও গেজেট না হওয়ায় হতাশায় আছেন ৪৩তম বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ ২ হাজার ১৬৩ জন প্রার্থী। ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল। সব পরীক্ষা শেষে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত উত্তীর্ণদের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। কিন্তু নয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো তাঁদের গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। অথচ একই বিসিএস থেকে নন–ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তরা গেজেটপ্রাপ্ত হয়ে যোগদান করেছেন।

অভিযোগ উঠেছে, গত ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনে পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ ৪৩তম বিসিএসে ছাত্রলীগের কেউ আছে কি না খোঁজ নিতে ফের যাচাই–বাছাই এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কথা বলছেন। এ কারণেই কি গেজেট বিলম্বিত? এ যেন রাজনৈতিক রং খোঁজার সেই পুরোনো অপচর্চা, যার ভুক্তভোগী কোটামুক্ত বিসিএসে মেধায় উত্তীর্ণ দুই হাজারেরও বেশি প্রার্থী।

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত এক মাসে যেসব কাজ করেছে, ৮ সেপ্টেম্বর তার একটি বিবরণ প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়েছে, ৪৩তম বিসিএসের সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উপস্থিত হতে পারেননি, তাঁদের পুনরায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৫৫ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে যাচাই-বাছাই করার জন্য স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ামাত্র নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

অথচ ৪৩তম বিসিএসের সব প্রার্থীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশি যাচাই মে মাসেই শেষ হয়েছে। বগুড়ার যে পাঁচজন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অংশ নেননি, তাঁরা অন্য বিসিএসে যোগ দিয়েছেন। কাজেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা অবান্তর। মূল কারণ গোয়েন্দা প্রতিবেদন। রাজনৈতিক তালাশ। এসব কারণেই নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ছে।

গেজেট প্রকাশের আগে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্তদের পুলিশ যাচাইকরণ হয়। এটি পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) করে থাকে। কখনো কখনো গোয়েন্দা সংস্থা দিয়েও কাজটি করানো হয়েছে। পুলিশ প্রতিবেদনে কী যাচাই হয়?

বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন প্রার্থীর প্রাক্-যাচাই ফরমে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হয়। সাধারণ তথ্যের পাশাপাশি তিনি কোনো মামলায় গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হয়েছেন কি না, এই তথ্য চাওয়া হয়। উত্তীর্ণ হওয়ার পর এসব যাচাই শেষ করে পুলিশের বিশেষ শাখা প্রতিবেদন দেয়। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য যাচাই করার কথা না থাকলেও বছরের পর বছর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রার্থীর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করছে। সংকটের শুরু এখানেই।

কয়েকটি ঘটনা বলি। প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এক তরুণীর নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পরিবারের কেউ রাজনীতি করেন না। কিন্তু গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁর মা দুবার বিএনপির সমর্থনে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। অথচ তাঁর মা দুবারই নির্বাচন করেছেন স্বতন্ত্রভাবে। এই কারণে গেজেট হয়নি।

চট্টগ্রামের একজন প্রার্থীর বাবা বিএনপির সমর্থক ছিলেন বলে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো মিথ্যা মামলায় আসামি করা হয় তাঁকে। পরে তাঁর বাবা মারা যান। কিন্তু ওই মামলা সূত্রে নিয়োগ আটকে ছিল।কক্সবাজারে ৩৮তম পুলিশ ক্যাডারে মনোনীত একজনের বাবা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ওই ছেলের নামের শেষে সাঈদী থাকায় তাঁর নিয়োগ আটকে যায়।

এক ৩৪তম বিসিএসেই এমন সব ঘটনায় ১৩৪ জনের চাকরি আটকে ছিল। তাঁদের অনেকেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দিনের পর দিন ঘুরে পুনরায় যাচাইয়ের পর চাকরি পেয়েছেন। এর পরও আটকে ছিলেন ২৬৫ জন, যাঁরা সরকার পতনের পর সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েছেন।

প্রথম আলোতে এক প্রতিবেদনে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া একজনকেও আটকে দেওয়া ঠিক নয়। এটা অন্যায়। এটা অনৈতিক চর্চা। এই সংস্কৃতি বন্ধ করা উচিত।’

আলী ইমাম মজুমদার এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। তিনি নিশ্চয়ই অতীতের কথাটা মনে রাখবেন এবং দ্রুততার সঙ্গে ৪৩তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশ করার বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন।

আরেকটি বিষয়। বাংলাদেশে এখন একেকটি বিসিএসের ফল প্রকাশ ও নিয়োগে চার বছর লাগে। চার বছরে পৃথিবীর বহু দেশে এক সরকার ক্ষমতা শেষ করে আরেক মেয়াদ আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্নাতক শেষ করা যায়। কিন্তু চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হয় না। এর মধ্যে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর গেজেট প্রকাশ করতে এক বছরের বেশি সময় নেওয়া দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পুনরায় যাচাই করে সময় ক্ষেপণ না করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর কোনো ফৌজদারি অপরাধ না থাকলে গেজেট প্রকাশ করা উচিত।

আর শুধু নিয়োগ নয়, সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরও রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজার সংস্কৃতি বন্ধ করা উচিত। রাজনৈতিক পরিচয় কোনোভাবেই সরকারি চাকরির যোগ্যতা বা অযোগ্যতা হতে পারে না। বরং একজন কর্মকর্তার নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতিতে মেধা, সততা ও যোগ্যতাই বিবেচ্য হওয়া উচিত।

  • শরিফুল হাসান কলাম লেখক ও বিশ্লেষক।