প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

৬ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ছবি: ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে

চার দিনের ভারত সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছেন ৮ সেপ্টেম্বর। ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ছাড়াও দুই নেতার মধ্যে একান্তে আলাপ হয়েছে। বৈঠক শেষে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে।

ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন শেখ হাসিনা। ৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে গার্ড অব অনারসহ আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানানো হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে।

সফরের শুরুতে ছোট দুটি ‘ঘটনা’ বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের তালিকা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাদ পড়েন শেষ মুহূর্তে। গত মাসে ভারত সফরের পর তিনি কিছু বেফাঁস বক্তব্য দেন, যাতে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় সরকারই বিব্রত বোধ করে।

সাধারণ্যে বিশ্বাস, এ কারণেই তাঁকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারিভাবে বলা হয়েছে, অসুস্থ থাকায় তিনি সফরসঙ্গী হয়ে দিল্লি যেতে পারেননি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি পৌঁছার পর বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান ভারত সরকারের এক প্রতিমন্ত্রী। আগেরবার প্রধানমন্ত্রী মোদি স্বয়ং বিমানবন্দরে ছিলেন তাঁকে স্বাগত জানাতে। এবার আসেননি বিধায় এ নিয়েও কিছু গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের আগমন ও প্রস্থানকালের প্রটোকল কী হবে—এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশ আলাদা নিয়ম পালন করে।

বাংলাদেশে আগত সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি বিমানবন্দরে স্বাগত জানান, বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভারতের প্রটোকল অনুযায়ী সাধারণত স্বাগত জানান মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী। আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানানো হয় পরদিন রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে গার্ড অব অনার ইত্যাদির মাধ্যমে। আগেরবার বিমানবন্দরে মোদির উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক প্রটোকলের বাইরে অতিরিক্ত সৌজন্য। প্রতিবারই এমনটি হতে হবে, তেমন কোনো কথা নেই।

৬ সেপ্টেম্বর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পরদিন ৩৩ অনুচ্ছেদের এক যৌথ ঘোষণা জারি করা হয়। সীমিত পরিসরে এর সব কটি পর্যালোচনা সম্ভব নয়। এর অনেকগুলো অনুচ্ছেদ মূলত গতানুগতিক, অনেকগুলো নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতা। যেমন দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক এবং উচ্চপর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে সফর বিনিময়ে সন্তোষ প্রকাশ, সাংস্কৃতিক বন্ধন, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বা যেসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে তাতে সাফল্য কামনা ইত্যাদি।

তবে এর বাইরেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ই আলোচনায় উঠে এসেছে। এর কোনোটিতে অগ্রগতির দিকনির্দেশনা ছিল, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে সমাধানের আপাতসম্ভাবনা নেই, তা-ও স্পষ্ট হয়েছে কূটনৈতিক শব্দাবলির নিপুণ ব্যবহারের আড়ালে।

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা ধারাবাহিকভাবে পরস্পরের দেশে সফরে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরকে সে ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই দেখা উচিত। একটি সফরে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে—এমন প্রত্যাশা বাস্তবানুগ নয়। বস্তুত, এ সফরের আগে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খুব বড় কোনো প্রত্যাশাও পরিলক্ষিত হয়নি। সফরের সাফল্য বা ব্যর্থতা সব সময় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নিরিখে বিচারযোগ্য নয়।

দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত স্মারকটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একটি সেচ প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য এই স্মারকের আওতায় ১৫৩ কিউসেক পানি তুলতে পারবে বাংলাদেশ। ভারতের সম্মতির অনুপস্থিতিতে প্রকল্পটি চালু করা যাচ্ছিল না।

এ অবস্থায় এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। পাশাপাশি তিস্তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতোই ২০১১ সালে স্বীকৃত খসড়া অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদনের তাগিদ দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি ২০১৭ সালে বলেছিলেন, সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মধ্যেমে এটি করতে হবে। ২০১৯ সালে তিনি জানিয়েছিলেন, অংশীজনদের সঙ্গে তিনি আলোচনা করছেন। এবার শেখ হাসিনার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কিছুই বলেননি। তাঁর এ নীরবতা তিস্তা হিমঘরে চলে গেছে বলে প্রচলিত ধারণাকে নিশ্চিত করল।

দীর্ঘ বিরতির পর যৌথ নদী কমিশনের ৩৮তম সভা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়ায়ও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। অভিন্ন নদীগুলোর তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের নির্দেশ আছে। ৩০ বছর ধরে তথ্য-উপাত্ত বিনিময় করে ক্লান্ত বাংলাদেশের পানিবিশেষজ্ঞরা, যাঁদের অনেকে এ কাজ করতে করতে অবসরে চলে গেছেন। তাঁরা এখন মাঠপর্যায়ে কিছু বাস্তব অগ্রগতি দেখতে চান।

গঙ্গা চুক্তির অধীন বাংলাদেশের প্রাপ্ত পানির যথাযথ ব্যবহার নিরীক্ষার জন্য একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কার্যক্রম ও পথপরিক্রমা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। পাঁচ বছর পর গঙ্গা চুক্তি নবায়নকালে এই নিরীক্ষার ফল নিঃসন্দেহে প্রভাব রাখবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত তার পরিচিত অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করেছে। বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, টেকসই এবং সত্বর স্বদেশে ফেরতের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশকে সমর্থন দিতে ভারত অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। বাস্তুচ্যুতিতে যারা বল প্রয়োগ করেছে, অর্থাৎ মিয়ানমার, তাদের সমর্থন কী করে সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে, তা ঠিক বোধগম্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফেরতে মিয়ানমারের ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করবে না ভারত।

একইভাবে সীমান্ত হত্যা নিয়েও ভারতের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় নয় এ যৌথ ঘোষণায়। এ হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে—এমন কথা বহু বছর ধরে শুনে আসছে বাংলাদেশ। আর এটা যে নিতান্তই কথার কথা, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ভারতে শেখ হাসিনার উপস্থিতিকালেই দিনাজপুর সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক এক বাংলাদেশি তরুণকে গুলি করে হত্যায়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি থেকেও থাকে দিল্লিতে, মাঠপর্যায়ে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের জবাবদিহির অনুপস্থিতি যত দিন বজায় থাকবে, তত দিন তাঁরা এ নিষ্ঠুরতা চালিয়েই যাবেন।

রেল ও সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে বেশ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যৌথ ঘোষণায়, তবে তা মূলত দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে। চতুর্দেশীয় যোগাযোগ উন্নয়নে প্রকৃত কোনো দিকনির্দেশনা নেই। নেপাল ও ভুটানে ট্রানজিট-সংক্রান্ত ২০ অনুচ্ছেদ আমার কাছে বিভ্রান্তিকর ঠেকেছে।

এখানে বলা হয়েছে, ভারতীয় পক্ষ বাংলাদেশকে অবহিত করল যে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য ভারত বাংলাদেশকে তার এলাকার ভেতর দিয়ে ‘ফ্রি ট্রানজিট’ দিয়েছে। তা-ই যদি হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ এত দিন এটা জানল না কেন? কারও কাছে আমি এর সদুত্তর পাইনি। আমার মনে হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি খোলাসা করতে পারে। আগ্রহী কোনো ব্যবসায়ী পরীক্ষামূলকভাবে নেপালে একটি চালান পাঠিয়ে দেখতেও পারেন, কতটা মসৃণভাবে এই ‘ফ্রি ট্রানজিট’ হাসিল করা যায়।

বিদ্যুৎ বিতরণে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের পাওয়ার গ্রিড সংযুক্তিকরণে গুরুত্বারোপ করা হয় যৌথ ঘোষণার ১৫ অনুচ্ছেদে। আর এ জন্য বিহারের কাটিহার এবং বাংলাদেশের পার্বতীপুরের মধ্যে গ্রিড যুক্ত করতে দুপক্ষই সম্মত হয়। লক্ষণীয়, এটিও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেই, নেপাল বা ভুটান এতে নেই।

নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত জানায়, এ বিষয়ে ভারতে নির্দেশিকা (গাইডলাইন) বিদ্যমান। সে নির্দেশিকার কোনো ব্যাখ্যা অবশ্য দেওয়া হয়নি, আর তার আওতায় নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি সম্ভব কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়। পানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় কোনো প্রকৃত অগ্রগতি সাধন করতে চাইলে এর আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন ভারতের।

সেপা চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এটি একটি ভালো উদ্যোগ।

তবে শুধু আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর না করে আলোচনার প্রক্রিয়ায় অংশীজনদের, অর্থাৎ দুই দেশের ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ তো করবেন তাঁরাই। দুই দেশের ব্যবসায়ীদের স্বার্থই যেন এতে রক্ষিত হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সংবাদ সম্মেলন এবং সেখানকার কিছু বিশ্লেষকের পর্যালোচনা থেকে মনে হয়েছে, ভারতের পক্ষ থেকে এই সফরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল বাংলাদেশে চীনের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ে ভারতের উদ্বেগ।

যৌথ ঘোষণায় অবশ্য তার প্রতিফলন নেই। এমন হতে পারে যে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে হয়তো ভারত বিষয়টি উত্থাপন করেছে। ভারতের এ উদ্বেগ অবশ্য খুব একটা যৌক্তিক নয়। নিজ প্রয়োজন এবং স্বার্থে বাংলাদেশ উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।

সব মিলিয়ে কেমন হলো সফরটি? বাংলাদেশ ও ভারতের মতো বন্ধুপ্রতিম ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ থাকাটা স্বাভাবিক।

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা ধারাবাহিকভাবে পরস্পরের দেশে সফরে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরকে সে ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই দেখা উচিত। একটি সফরে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে—এমন প্রত্যাশা বাস্তবানুগ নয়। বস্তুত, এ সফরের আগে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খুব বড় কোনো প্রত্যাশাও পরিলক্ষিত হয়নি। সফরের সাফল্য বা ব্যর্থতা সব সময় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নিরিখে বিচারযোগ্য নয়।

  • মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব