ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়েছে
ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়েছে

আসিফ নজরুলের কলাম

যে বিচারের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব

ন্যায়বিচার নিয়ে নানা অসন্তোষ রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সেখানে দুর্বল দেশের বহু ধরনের বিচার হয়, বিচার হয় না পরাক্রমশালী দেশের। পশ্চিমা দেশগুলো প্রথমোক্তদের বিচারে উদ্যোগী ভূমিকা নেয়, কিন্তু তাদের নিজেদের ও মিত্রদের বিচারের আওতার বাইরে রাখে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ইসরায়েলের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অবস্থান।

গত সাত দশকে জাতিসংঘের অসংখ্য প্রস্তাব ইসরায়েল উপেক্ষা করেছে, বহু আন্তর্জাতিক অপরাধ দেশটির শাসক ও সেনাশাসকেরা করেছেন। কিন্তু এ জন্য কোনো দায়বদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁদের মূলত উপরিউক্ত দেশগুলোর প্রশ্রয়ের কারণে।

এ রকম পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও এর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসির (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন সারা বিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।

কয়েক দিন আগে আইসিসির চিফ প্রসিকিউটর করিম খান যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য তাঁদের (ও তিন হামাস নেতার) বিরুদ্ধে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য আইসিসির বিচারকদের কাছে আবেদন করেছেন।

এই পরোয়ানা জারি হবে কি না, তা আইসিসির বিচারকেরা নিষ্পত্তি করবেন। তবে ইসরায়েলের অপরাধের মানদণ্ড এবং আইসিসির কার্যক্রমের প্রকৃতি অনুসারে এটি না হওয়ার কারণ নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যি কি ইসরায়েল বা এর প্রধানমন্ত্রীর কোনো সমস্যা হবে এতে? সত্যি কি বৈশ্বিকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এটি একটি উজ্জ্বল ও অনুপ্রেরণাদায়ক নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে?  

২.

বছর বিশেক আগে ‘রোম স্ট্যাটিউট’ নামের আন্তর্জাতিক চুক্তিবলে আইসিসি প্রতিষ্ঠিত হয় গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর (যেমন গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ) জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করার জন্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই আদালতের বিচার সীমাবদ্ধ ছিল মূলত বিশ্বরাজনীতিতে দুর্বল আফ্রিকান দেশগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে।

সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্তান, ভেনেজুয়েলা ও মিয়ানমারের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ও অতি সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে তদন্তের সূচনা করে আইসিসি এই দুর্নাম কিছুটা ঘোচাতে পেরেছে।

তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের বহু অভিযোগ থাকলেও এই আদালত পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র বা এর মিত্রদেশগুলোর কারও বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ ইসরায়েলের পরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বর্তমান উদ্যোগ তাই নজিরবিহীন হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে।

ইসরায়েল (এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা চীন) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পক্ষরাষ্ট্র নয়। ইসরায়েলের দাবি হচ্ছে, নেতানিয়াহুর বিচার করার এখতিয়ার তাই এই আদালতের নেই।

আইসিসির প্রিট্রায়াল চেম্বার অবশ্য ২০২১ সালেই এই এখতিয়ার আছে বলে রায় দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ফিলিস্তিন ২০১৫ সালে রোম স্ট্যাটিউটের পক্ষরাষ্ট্র হওয়ার কারণে সেখানে (পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম) সংগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করার অধিকার আছে আইসিসির।

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদনের পর আইসিসির এই বিচারকার্যের (এবং একই সঙ্গে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা আনীত গণহত্যার অভিযোগের তদন্তের) অগ্রগতির দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ। গাজায় ইসরায়েলের বাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নজিরবিহীন আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তাঁরা। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তাই বৈশ্বিক মানবতাবাদী আন্দোলন নতুন প্রেরণা পাবে, এর চাপে পশ্চিমা দেশগুলোকে কিছুটা হলেও ইসরায়েলপন্থী একচোখা মনোভাব পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

টেরিটোরিয়াল জুরিসডিকশনের এই নীতি এর আগেও আইসিসি মিয়ানমার ও রাশিয়ার মতো রোম চুক্তির পক্ষ নয়, এমন দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। কাজেই প্রিট্রায়াল চেম্বারের এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না তখন। তবে এটি যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর্যায়ে যেতে পারে, তা তখন ধারণা করা যায়নি।

নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারির আবেদনের এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। আইসিসির বিচারকদের কাছে এই আবেদন খারিজ করার জন্য যুক্তি প্রদানের সুযোগ ইসরায়েলের রয়েছে।

তবু নেতানিয়াহু নিজে কঠোরতম ভাষায় এর সমালোচনা করেছেন। তিনি আইসিসির চিফ প্রসিকিউটরকে নাৎসি জার্মানির বিচারকদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, ‘যাঁরা ইহুদিদের মৌলিক অধিকার নাকচ করে তাঁদের গণহত্যার (হলোকাস্ট) পথ সুগম করেছিলেন।’ যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের মিত্র হিসেবে সুপরিচিত রিপাবলিকান পার্টির সিনেটরদের একটি গ্রুপ ইসরায়েলকে টার্গেট করা হলে আইসিসিকে উল্টো টার্গেট করার নজিরবিহীন হুমকি প্রদান করেছে।

এসব কঠোর প্রতিক্রিয়া এই ইঙ্গিতই প্রদান করে যে ইসরায়েল সত্যি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে, এই আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। আসলেও এটি হলে ইসরায়েলের সরকারপ্রধানকে বহু বাস্তব সমস্যার মুখে পড়তে হবে। সমস্যায় পড়তে হবে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকেও।

৩.

ইসরায়েলের জন্য প্রথম সমস্যা হচ্ছে, আইসিসি কর্তৃক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এড়ানো। অতীতে আইসিসির প্রসিকিউটররা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছেন আর তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এই নজির নেই বললে চলে। ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা আরও কম বিভিন্ন কারণে।

আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান অভিযোগ করেছেন যে ইসরায়েল গাজায় বেসামরিক মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছে, গুরুতরভাবে আহত করেছে এবং অসীম ভোগান্তি ও ক্ষুধার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই অভিযোগ অস্বীকার করার উপায় নেই। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে নিহত প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ এবং আহত প্রায় ৮০ হাজার মানুষের অধিকাংশই শিশু, নারী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ বেসামরিক ব্যক্তি।

এটি যে জেনেবুঝে করা হয়েছে, তার প্রমাণ ইসরায়েলের নেতাদের বক্তব্যেও রয়েছে; যেমন গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের দুই দিন পরে এই প্রতিশোধমূলক হত্যাযজ্ঞ শুরু করার সময় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছি। সেখানে কোনো বিদ্যুৎ, কোনো খাবার, কোনো জ্বালানি থাকবে না, সব বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

তিনি গাজার অধিবাসীদের মানুষরূপী জন্তু হিসেবে আখ্যায়িত করে সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন। হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র, শরণার্থীশিবিরসহ সমগ্র গাজায় সর্বাত্মক আক্রমণ এবং অসংখ্য শিশুর পোড়া বা ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের সঙ্গে এ ধরনের বক্তব্য আইসিসির বিচারকদের নজর এড়ানোর কথা নয়।

ইসরায়েলের জন্য দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তার ফলাফল মোকাবিলা করা। আইসিসির ১২৪টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাকারী বহু ইউরোপিয়ান (এবং কানাডা ও জাপানের মতো সম্পদশালী রাষ্ট্র) দেশ। রোম স্ট্যাটিউট অনুসারে আইসিসির রায় বাস্তবায়নে এসব দেশ বাধ্য। এসব দেশে তাই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে ভ্রমণ করার আগে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি বিবেচনায় নিতে হবে।

অন্যদিকে এসব ইউরোপিয়ান দেশ যদি গ্রেপ্তারের বাধ্যবাধকতা না মানে, তাহলে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা ধ্বংস করার এবং বিশ্বব্যাপী নৈতিকতার মোড়লিপনা হারানোর ঝুঁকি তাদের নিতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের জন্য প্রধান সমস্যা হবে তাদের ভাবমূর্তির ক্ষতি। নিজেকে গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে পরিচয় দেওয়ার অহং ও অধিকার দেশটির ক্ষুণ্ন হবে, ভিকটিমহুডের কূটনীতির যে শক্তি তা বিপর্যস্ত হবে।

৪.

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদনের পর আইসিসির এই বিচারকার্যের (এবং একই সঙ্গে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা আনীত গণহত্যার অভিযোগের তদন্তের) অগ্রগতির দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ। গাজায় ইসরায়েলের বাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নজিরবিহীন আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তাঁরা।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তাই বৈশ্বিক মানবতাবাদী আন্দোলন নতুন প্রেরণা পাবে, এর চাপে পশ্চিমা দেশগুলোকে কিছুটা হলেও ইসরায়েলপন্থী একচোখা মনোভাব পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

এসব আশাবাদের পাশাপাশি আশঙ্কাও রয়েছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে কোনো কারণে আইসিসি এই বিচারে ব্যর্থ হলে বা তাঁকে ব্যর্থ করে দেওয়া হলে বৈশ্বিক আইনের শাসনের স্খলন ও একচোখা নীতি আরও প্রকট হয়ে উঠবে। বিশ্বের স্বৈরশাসক, অত্যাচারী ও আধিপত্যবাদী নেতাদের দৌরাত্ম্য মোকাবিলা করা তখন আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক