হারানো পাহাড় ফিরে আসবে না, আস্থা কি ফিরে আসবে?

এক শতাব্দী সময়ের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বেশির ভাগ পাহাড় অস্তিত্ব হারিয়েছে।
ফাইল ছবি

পাহাড় কাটা রোধে ১১ জুন রোববার একটি মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ তাঁদের মনের ঝাল মিটিয়েছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ ও অন্য কর্তাব্যক্তিদের সামনে। খোদ মেয়র চউকের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেন। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে চট্টগ্রামে অনেক পাহাড় কাটা হয়েছে বলে মেয়র আক্ষেপ করেন। তিনি নিজেই স্বীকার করলেন, একটু সদিচ্ছা, আন্তরিকতা থাকলে পাহাড় না কেটেও এসব উন্নয়ন বা সংস্কার করা যেত। এই আক্ষেপ মেয়রের একার নয়, চট্টগ্রামের সব সচেতন মানুষের। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো মচমচে পাঁপড়ভাজার মতো সাবাড় করে ফেলেছে সবার চোখের সামনে।

ব্যক্তিগত বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ হাসিলের জন্য যে যার ইচ্ছেমতো পাহাড় কেটেছে। তাতে পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবছর পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঘটছে। ২০১০ সাল থেকে এযাবৎ তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু পাহাড় কাটা থামছে না। পাশাপাশি পাহাড়ে কিংবা পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যাও কমছে না। লুপ্ত হতে হতে পাহাড় যখন একেবারে নিঃশেষ প্রায়, তখনই মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে সিটি করপোরেশন। তারপরও মানুষের মৃত্যু আর পরিবেশে বিপর্যয়ের শিকার চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আগ্রহ নিয়ে, মনে ক্ষোভ নিয়ে গিয়েছিলেন।

আমারও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে।

সেদিন প্রবর্তক পাহাড়ের পাদদেশে হিলভিউতে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে গোলপাহাড়, মোলহিল হয়ে টাইগার হিল, বাটালি পাহাড় আর জিলাপি পাহাড়ের পাশ দিয়ে সিআরবি পাহাড় পেরিয়ে স্টেশন রোডের মোটেল সৈকতের সভাস্থলে গিয়েছিলাম। এই চার কিলোমিটার পথ অতিক্রমের কথা বলতে গিয়ে যে কটি পাহাড়ের নাম উল্লেখ করলাম, সেগুলো শুধু নামেই আছে, বাস্তবে নেই। চট্টগ্রাম নগরের আরও বহু এলাকার সঙ্গে পাহাড় নামটি যুক্ত। বাস্তবে সেখানে এখন পাহাড়ের ছিটেফোঁটাও নেই। কিছু কিছু এলাকায় পাহাড় টিকে থাকলেও তা কর্তিত, খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে।

চট্টগ্রাম নগর দীর্ঘ ১ হাজার ৪০০ বছরের পথচলায় পরিধি বিস্তারের পাশাপাশি অতীত চেহারা হারিয়েছে। এখানকার বেশির ভাগ প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক—এমনকি পারিবারিক স্থাপনাও গড়ে উঠেছিল পাহাড়ের শীর্ষে অথবা তার পাদদেশে। সে জন্যই পাহাড় শব্দটি অনিবার্যভাবেই জুড়ে আছে প্রতিটি নামের সঙ্গে। আর এসব নাম ধারণ করে আছে হাজার বছরের চট্টগ্রামের স্মৃতি। ইতিহাসের নানা বাঁকের সাক্ষী হয়ে আছে এগুলো।

কর্তিত পাহাড়ে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের লাইন কীভাবে পাওয়া যায়, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সেদিন। পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা জায়গায় সিটি করপোরেশন পাকা সড়ক করে দিচ্ছে বলেও মেয়রের সামনে অভিযোগ তুলেছে সেদিন। সেসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া না গেলেও কিছু কিছু সুপারিশ সেদিন পাওয়া গেছে, যা বাস্তবায়ন করলে পাহাড় কাটার মহোৎসবের অন্তত ভাটা পড়বে বলে মনে হয়।

এক শতাব্দী সময়ের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বেশির ভাগ পাহাড় অস্তিত্ব হারিয়েছে। ঘন সবুজ এক আরণ্যক পরিবেশে পাহাড়ের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম নগর। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনাহীনভাবে পাহাড় কাটার ফলে ভূমি জরিপের খতিয়ানে অনেক পাহাড়ের অস্তিত্বের প্রমাণ থাকলেও বাস্তবে সেগুলো আর দেখা যায় না। চট্টগ্রাম নগরের ইতিহাস-সম্পর্কিত বইপত্রেও নানা পাহাড়ের নাম আছে, যেগুলো বর্তমানে দেখা যায় না। আশির দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম শহরে ২৩০টি পাহাড়ের চূড়া চিহ্নিত করা হয়েছিল। নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে সরকারি-বেসরকারি মিলে অর্ধশত পাহাড়ের চূড়া দেখা যেত।

সিটি করপোরেশনের মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ান হাসান একটি গবেষণার বরাত দিয়ে বলেন, ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার পাহাড় ছিল। ২০০৮ সালে তা কমে ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে নেমে আসে।

চট্টগ্রামে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছোট-বড় ১২০টি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু পাঁচলাইশ এলাকায় ৭৪ শতাংশ পাহাড় ধ্বংস করা হয়েছে। আকবর শাহ এলাকায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নির্বিচারে পাহাড় কাটার কথাও বললেন তিনি।

পাহাড়ের এমন পরিসংখ্যানে হাহাকার আর আক্ষেপ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ, যে পাহাড় হারিয়ে গেছে, তা আর কখনো ফিরে আসবে না। এ জন্যই সিটি মেয়র সেদিন সভায় বলেছিলেন, পাহাড় কাটলে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাই পাহাড় কাটা বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। তিনি পাহাড়খুনিদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বললেন।

সেদিনের মতবিনিময় সভায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা উপস্থিত সুধীজনদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। পাহাড় রক্ষায় সেগুলো খুব জরুরি বলেও সবাই মত দিয়েছেন। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কথাটি ছিল পাহাড় কাটার শাস্তি কী হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে। সভায় বলা হয়, পাহাড় কাটার জন্য ৫০ হাজার, ১ লাখ টাকা জরিমানা করে পাহাড় কাটা বন্ধ হবে না। পাহাড়খেকোদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রাখতে হবে।

সভায় পাহাড়র কাটার জন্য অন্যান্য ব্যক্তি ও সংস্থার পাশাপাশি চউককে দায়ী করা হয়। কারণ, চউক পাহাড় কেটে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তা ছাড়া কর্তিত পাহাড়গুলোতে চউক বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়ে পাহাড় কাটাকে উৎসাহিত করেছে যুগ যুগ ধরে। প্রথমত, সিডিএকে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে, খতিয়ানে পাহাড় বলে চিহ্নিত জায়গায় কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। পাহাড় কেটে যদি ভবন নির্মাণ করা না যায়, তবে কাটা নিরর্থক হবে। তাতে তারা নিরুৎসাহিত হবে।

কর্তিত পাহাড়ে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের লাইন কীভাবে পাওয়া যায়, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সেদিন। পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা জায়গায় সিটি করপোরেশন পাকা সড়ক করে দিচ্ছে বলেও মেয়রের সামনে অভিযোগ তুলেছে সেদিন। সেসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া না গেলেও কিছু কিছু সুপারিশ সেদিন পাওয়া গেছে, যা বাস্তবায়ন করলে পাহাড় কাটার মহোৎসবের অন্তত ভাটা পড়বে বলে মনে হয়।

সুপারিশে বলা হয়, পাহাড়গুলোর বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করে একটি জরিপ চালিয়ে কোথায় কোন পাহাড় আছে, তা চিহ্নিত করা; পাহাড় কাটা রোধে একটি হটলাইন চালু করা; কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আর পাহাড় না কাটা খুব জরুরি। পাহাড় কেটে বাড়ি বা স্থাপনার কোনো পরিকল্পনায় চউক অনুমোদন দিতে পারবে না। বিভিন্ন পাহাড়ে নির্মাণাধীন স্থাপনার কাজ দ্রুত বন্ধ করে দিতে হবে; পাহাড় কাটা রোধে ও পাহাড়ের সুরক্ষায় সমন্বয় সেল বা আলাদা এনফোর্সমেন্ট সেল বা টিম গঠন করতে হবে; যেসব ওয়ার্ডে পাহাড় আছে, সেখানকার জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করতে হবে; পাহাড়, খাল, ছড়া রয়েছে, এসব জায়গায় বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বন্ধ করা। সভায় মেয়র সুপারিশ বলেন হারিয়ে যাওয়া পাহাড় আর ফিরে পাব না। তাই কর্তিত পাহাড়ের এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করে সেখানে দেশীয় গাছপালা রোপণ করে অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনা দরকার।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আয়োজিত এই সভায় সেদিন সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চউক কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি ও জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সবার সামনে যে সুপারিশগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় চট্টগ্রামবাসী। কারণ, পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ রকম বহু সুপারিশের বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমরা অভ্যস্ত।

বাস্তবায়ন আমরা চোখে দেখি না। সিটি করপোরেশন সেদিনের সভাটি কতটা আন্তরিকভাবে করেছে, সেটা বোঝা যাবে এই সভার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ব্যাপারে তারা কতটা তৎপর, তা দেখে। হারানো পাহাড় কখনো ফিরে আসে না। কিন্তু হারানো আস্থা কখনো কখনো ফিরে আসে। সিটি করপোরেশনের ওপর আমাদের আস্থা কি ফিরে আসবে?

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক