শিক্ষা নিয়ে পরীক্ষার শেষ কোথায়

আমাদের শৈশবে পাঠ্যক্রম কিংবা পাঠ্যপুস্তকের তেমন কোনো পরিবর্তন হতে দেখিনি। বড় ভাইবোনের পঠিত বই দিয়েই অনেকটা স্কুলজীবন পাড়ি দিতাম। স্কুলের পড়াশোনা ছিল আমাদের কাছে আনন্দেরই অন্য নাম।

স্কুলে আসা-যাওয়ার পথটিও ছিল আনন্দে ঠাসা। ঋতু পরিবর্তন, রংধনু, বীজের অঙ্কুরোদ্‌গম, রঙিন প্রজাপতি কিংবা লাল-নীল ফড়িংয়ের সঙ্গে আমাদের মিতালি হতো স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে।

বছরের পর বছর পাঠ্যপুস্তক কিংবা এর বিষয়বস্তু অপরিবর্তিত থাকবে, তা মোটেই কাম্য নয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার হবে, পাঠ্যক্রমের আধুনিকায়ন হবে, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জিত হবে, এর বিষয়বস্তুর পরিবর্তন-সংযোজন-বিয়োজন হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ পরিবর্তন যখন অতি দ্রুতগতিতে হতে থাকে, তখন তা আবার চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এতে শিক্ষার্থীদের সামনে না এগিয়ে বরং পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আর শিক্ষাক্ষেত্রে শিশুদের পিছিয়ে পড়ার অর্থ হলো অন্তঃসারশূন্য একটি প্রজন্মের আবির্ভাব। এক যুগ ধরে নানা পরিবর্তন দেখে মনে হয় ভয়াবহ এক অস্থিরতা বিরাজ করছে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে।

শিক্ষার্থী তো দূরের কথা, তাদের অভিভাবকেরাও এত ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। শিক্ষকেরা কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক, শিখন-শিক্ষণ, মূল্যায়ন পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও জ্ঞান লাভ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছেন। একটি পদ্ধতির ওপর দখল আসতে না আসতেই আরেকটি পদ্ধতি এসে হাজির হচ্ছে।

যদি নিকট অতীতে তাকাই, ২০০৯ সালে শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার; যেখানে অংশ নেয় পঞ্চম শ্রেণির শিশুরা। পরে চালু হয় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা জেএসসি পরীক্ষা। প্রথম থেকেই নানা আলোচনা-সমালোচনায় থাকা এই পাবলিক পরীক্ষা দুটি প্রায় এক যুগ চালু থাকার পর ২০২৩ সাল থেকে বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

সাময়িক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ এবং অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উন্নীত করা হবে। শিক্ষার্থী মূল্যায়নের পদ্ধতিতে এসেছে পরিবর্তন। ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে যে জিপিএ পদ্ধতি চালু হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্তরে সম্প্রসারিত হয়েছে, গ্রেডিং পদ্ধতিরও সংস্কার হয়েছে।

করোনা–পরবর্তী বাস্তবতায় শিক্ষাক্ষেত্র যখন এমনিতেই টালমাটাল, সেই সময় এত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমরা আদৌ কি প্রস্তুত? নাকি এসব সিদ্ধান্তে ফলে একটা লেজেগোবরে পরিণতি দেখব আমরা। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থার এত সংস্কার ও আধুনিকায়নের নানা আয়োজনের পরও এর সুফল আমরা।

শিক্ষার্থীদের মুখস্থবিদ্যা থেকে সরিয়ে আনতে ২০১০ সালে যে সৃজনশীল পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সেই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত করানো ছিল যেন এক মহাযজ্ঞ। সেই সৃজনশীল পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর হয়েছে; তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা দেখেছি সৃজনশীল এই পদ্ধতিও কোচিং সেন্টার ও গাইড নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার কাছে কুপোকাত হয়েছে। ২০১০ সালে প্রণীত হয় জাতীয় শিক্ষানীতি। অথচ এই নীতির অধিকাংশই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

সম্প্রতি এসেছে বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্ত। যেমন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা থাকবে না। নবম–দশমে মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা নামে আলাদা বিভাগ থাকবে না এবং একটি সমন্বিত পাঠ্যক্রম অনুসরণ করবে সবাই। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য শাখার বিভাজন হবে উচ্চমাধ্যমিক থেকে।

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে; আর দুটি পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে। মূল্যায়নের মানদণ্ডে আবারও আসছে পরিবর্তন। প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার নতুন রূপরেখার কথা আলোচিত হচ্ছে।

শুনেছি মুখস্থবিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনতে এবং বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সমন্বয় আনতে নাকি দিনরাত কাজ করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরেই বেশ কিছু স্কুলে প্রথম শ্রেণি এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের পাইলটিং শুরু হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে নাকি পুরো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।

করোনা–পরবর্তী বাস্তবতায় শিক্ষাক্ষেত্র যখন এমনিতেই টালমাটাল, সেই সময় এত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমরা আদৌ কি প্রস্তুত? নাকি এসব সিদ্ধান্তে ফলে একটা লেজেগোবরে পরিণতি দেখব আমরা। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থার এত সংস্কার ও আধুনিকায়নের নানা আয়োজনের পরও এর সুফল আমরা দেখছি না।

২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গড়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মোট স্কুল শিক্ষাবর্ষের ৪ দশমিক ৫ বছর নষ্ট হয় নিম্নমানের শিখন-শিক্ষণ বাস্তবতার কারণে। ফলে ১১ বছর মেয়াদি স্কুলশিক্ষা শেষে তারা ষষ্ঠ শ্রেণি উপযোগী যোগ্যতা নিয়ে স্কুলজীবন শেষ করছে।

ন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট ২০১৭ অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায় এবং ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে। পঞ্চম শ্রেণির অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে মাত্র ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায় এবং ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে।

সমস্যা আসলে কোথায়; সমস্যা কি পদ্ধতিতে নাকি পদ্ধতির বাস্তবায়নে। বাস্তবায়ন যদি সমস্যার মূলে থেকে থাকে, তবে পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন করে কোনো লাভ হবে না। বরং এতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের দুর্ভোগ শুধুই বাড়বে। নতুন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে গবেষণা, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ আর অবকাঠামোগত উন্নয়নের মোড়কে বেরিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা, অথচ শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ক্রমেই নিম্নগামী। বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থার গল্প শিক্ষার্থীদের কাছে বিদেশি ডিগ্রি নেওয়া কিংবা দেশের বাইরে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে দিন দিন।

পরিশেষে বলতে চাই, শিক্ষাক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটুক। শিক্ষার্থীদের গুণগত মান উন্নয়নে চাই স্থিতিশীল পরিবর্তন। করোনা–পরবর্তী শিক্ষাক্ষেত্রে শান্তি ও স্থিতি ফিরে আসুক। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানলাভ হোক পরিপূর্ণ ও আনন্দময়।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী। purba_du@yahoo.com