অবৈধ দখলদার সীমিতসংখ্যক। তারাই কেবল নদীর শত্রু। অন্য সবাই নদীর সুরক্ষা চায়।
অবৈধ দখলদার সীমিতসংখ্যক। তারাই কেবল নদীর শত্রু। অন্য সবাই নদীর সুরক্ষা চায়।

নদী সুরক্ষায় ব্যক্তি ও সংগঠনের ভূমিকা যেখানে

নদী সুরক্ষায় ব্যক্তি ও সংগঠনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীর জন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতেন, নদীবিষয়ক আইনের যথাযথ প্রয়োগ হতো, তাহলে হয়তো নদী সুরক্ষায় ব্যক্তি বা সংগঠনের কোনো প্রয়োজন হতো না।

অনেকে নদীর ক্ষতি করেন, অবৈধভাবে দখল করেন, এমনকি এই দখল প্রক্রিয়ার সঙ্গে আছেন সরকারি-বেসরকারি কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু নদী সুরক্ষায় আইনের প্রয়োগ নেই, সরকারি সংশ্লিষ্ট  কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নেই, অপরাধীদের শাস্তির আওতায় নেওয়ার সংস্কৃতিও নেই। ফলে নদী সুরক্ষায় এখন সংগঠন ও ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে।

একটি নদী যদি কোথাও দখল, দূষণ কিংবা অন্য কোনো সংকটের মধ্যে পড়ে, তাহলে সেই নদী সুরক্ষায় ব্যক্তিও ভূমিকা রাখতে পারেন। সরকারের জরুরি কোনো ফোন নম্বর থাকলে সেখানে যে কেউ অভিযোগ জানাতে পারেন। ইন্টারনেটের সহায়তায় ফোন নম্বর সংগ্রহ করে এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যে কারও কাছে প্রতিকারের আবেদন করা যেতে পারে।

এতে কাজ না হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর লিখিতভাবে জানানো সম্ভব। গণমাধ্যমে বিষয়টি জানালেও অনেক সময় ক্ষতি রোধ করা যায়। অনেক সময় ব্যক্তি প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে কিংবা প্রতিকার চাইতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে আড়ালে রেখেও নদী সুরক্ষায় কাজ করতে পারেন।

ব্যক্তির তুলনায় সংগঠন নদী সুরক্ষায় শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। সংগঠন শক্তিশালী হলে প্রতিবাদ জোরালো হয়। নদীর দখল-দূষণ, বালু উত্তোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনেক সময় সরকারি কর্তাব্যক্তিও জড়িত থাকেন। নদী রক্ষকদের ভক্ষকের ভূমিকায় দেখা যায়। ঘটনা বিশেষে প্রতিকারও চাইতে হয় সেই ভক্ষকের কাছে। এমন বাস্তবতায় সামাজিক চাপ সৃষ্টি করতে হয় নদী সুরক্ষার জন্য।

নদীভিত্তিক সাংগঠনিক কার্যক্রম ইস্যুভিত্তিক হয়ে থাকে। সাধারণত একটি নদীর জন্য একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। এ রকম দৃষ্টান্ত বেশি। যাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে সারা দেশের নদী নিয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের কেন্দ্রীয় কমিটি, বিভাগীয় কমিটি, জেলা কমিটি থাকতে পারে। তবে নির্দিষ্ট নদীভিত্তিক সংগঠন থাকতেই হবে।

নদী সুরক্ষার কাজে নানান ঝুঁকি আছে। অবৈধ দখলদার কিংবা নদীর সর্বনাশকারীরা সব রকম অপবাদ দেওয়া, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা এমনকি মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে পারে। সাংগঠনিক কার্যক্রম কোনো অবস্থাতেই বন্ধ করা যাবে না। অবৈধ দখলদার সীমিতসংখ্যক। তারাই কেবল নদীর শত্রু। অন্য সবাই নদীর সুরক্ষা চায়। দেশের জন্য বৃহৎ স্বার্থে ব্যক্তি, সংগঠন মিলে নদী সুরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

নদী সুরক্ষার জন্য ধারাবাহিক কাজ করতে হবে। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক দপ্তরে প্রতিকার চেয়ে লিখিত দেওয়া যেতে পারে। জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে লিফলেট প্রচার, সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন, গণমাধ্যমে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার, সেমিনার-সভা-সম্মেলন করতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব হলে আন্দোলনের গুরুত্ব বাড়বে।

কদিন পরপর এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি বদলি হতে থাকেন। নদীসংশ্লিষ্ট নতুন যারাই বদলি হয়ে আসুক, শুরুতে তাদের কাছে নদীর সংকটগুলো তুলে ধরতে হবে। পরিবেশ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও মন্ত্রণালয়গুলোর কাছেও প্রতিকার চাওয়ার প্রয়োজন আছে।

নদী সুরক্ষায় সংগঠন কী করতে পারে, তার ছোট ছোট উদাহরণ বলি। ২০১৮ সালে খবর পাই নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার ‘দেওনাই’ নামে একটি নদী সরকারিভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করে অবৈধ দখলদারদের অনুকূলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ডিবিসি টেলিভিশনের রংপুর ব্যুরোপ্রধান নিশাত ইসলাম আমাকে খবরটি দেন।

আমি তাঁর মাধ্যমে ওই নদীর পাড়ে গিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের একত্র করে রিভারাইন পিপলের ‘দেওনাই নদী সুরক্ষা কমিটি’ গঠন করে দিই। এরপর এই সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে। আমাদের কমিটি গঠনের আগেও স্থানীয় ব্যক্তিরা নদীটি সুরক্ষায় চেষ্টা করেছিলেন। তখন তাঁরা সফল হতে পারেননি। ওই নদীতে সাধারণেরা মাছ ধরতে পারতেন না, এমনকি নদীতে নামতেও পারতেন না। নদীটির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য সেখানে এসিল্যান্ড সুপারিশ করেছিলেন।

সরেজমিন নদী ঘুরে এসে প্রথম আলো পত্রিকায় ‘দেওনাই কি জলমহাল হবে?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন লেখাটি আমলে নিয়ে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে আমাদের ধারাবাহিক চেষ্টায় নদীটি মুক্ত করা সম্ভব হয়।

রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলায় শালমারা নামে একটি নদী আছে। আশির দশকে সেখানে নদীটি রক্ষায় আন্দোলন হয়েছিল। পাঁচজন জেলও খেটেছিলেন। সেখানে রিভারাইন পিপলের ‘শালমারা নদী সুরক্ষা কমিটি’ গঠন করি। ধারাবাহিক অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। স্থানীয় সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমানেরও সহায়তা নেওয়া হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক আসিব আহসানের মাধ্যমে আমরা ওই নদী থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে পেরেছি।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারাহাট উপজেলায় একটি নদী আছে। উৎসস্থল থেকে তিস্তায় মিলিত হওয়া পর্যন্ত নদীটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। চাকিরপশার, মরাতিস্তা এবং বুড়িতিস্তা নামে প্রবাহিত। কয়েকটি মৌজায় এই প্রবাহটি সরকারি নথিপত্রে বিল শ্রেণিভুক্ত। বিল শ্রেণিভুক্ত অংশে প্রায় তিন শ একর জমি অবৈধভাবে অনেকে ভোগ করছিল। সেখানে আমরা ‘চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটি, রিভারাইন পিপল ও গণকমিটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি। সংগঠনটি নানা রকম কার্যক্রম গ্রহণ করে।

১৪১ একর জমি ইতিমধ্যে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ এবং রংপর বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম বিপ্লবের মাধ্যমে বদ্ধ জলাশয় বাতিলপূর্বক উন্মুক্ত জলাশয় ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা আশা করি সেখানে দেশের বিদ্যমান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। কেবল তা-ই নয়, সম্পূর্ণ নদীটি অবৈধ দখলমুক্ত হবে বলেই আমরা মনে করি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) নদীটি সুরক্ষায় উচ্চ আদালতে মামলা করেছে। আদালত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদপূর্বক নদীটি সুরক্ষায় যাবতীয় নির্দেশনা জারি করেছে। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকও ১২৯টি মামলা করেছে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে।

নদী সুরক্ষার কাজে নানান ঝুঁকি আছে। অবৈধ দখলদার কিংবা নদীর সর্বনাশকারীরা সব রকম অপবাদ দেওয়া, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা এমনকি মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে পারে। সাংগঠনিক কার্যক্রম কোনো অবস্থাতেই বন্ধ করা যাবে না। অবৈধ দখলদার সীমিতসংখ্যক। তারাই কেবল নদীর শত্রু। অন্য সবাই নদীর সুরক্ষা চায়। দেশের জন্য বৃহৎ স্বার্থে ব্যক্তি, সংগঠন মিলে নদী সুরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক