লোকে আপনাআপনি কারও নামের আগে ‘জনাব’ আর শেষে ‘সাহেব’ জুড়ে দিলে বুঝতে হবে, সেই লোক যে সে লোক না। বুঝতে হবে, সেই লোক নামজাদা। বুঝতে হবে, সেই লোক সম্মানিত এবং ক্ষমতাধর।
এক সময় পারস্যের শাহানশাহদের দরবারে প্রাদেশিক সিনিয়র মন্ত্রীদের আনুষ্ঠানিক টাইটেল ছিল ‘জনাব’।
আর দুই শ বছর শাসন করা বিলাতি সাহেবদের তো আমরা চিনিই। এই কারণে কারও নামের আগে ‘জনাব’, পরে ‘সাহেব’ বসালে নামটা কত ওজনদার হয়, তা আমরা বুঝি।
ধরা যাক, হাবুল নামের এক লোকের সঙ্গে বাবুল নামের আরেক লোকের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। হাবুল বছরের পর বছর ধরে হাটে-ঘাটে-মাঠে যেখানে সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই বাবুলকে চোরচোট্টা বলে গালি দিয়ে আসছে।
আচমকা একদিন দেখা গেল, হাবুল ভরা হাটে সবার সামনে বলছে, ‘জনাব বাবুল সাহেবের অনেক কথার সঙ্গে আমি একমত। আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাই।’
এই অবস্থায় ‘সুধী দর্শক-শ্রোতামণ্ডলীর’ ধাক্কা খাওয়া ছাড়া গতি থাকার কথা না।
পাবলিক তখন সন্দেহ করবে, হাবুল বেকায়দায় পড়ে এখন কায়দা করে বাধ্যতামূলক বাবুল-বন্দনা শুরু করেছে।
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ক্ষমতাচ্যুত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ গেল রোববার লন্ডনভিত্তিক ‘চ্যানেল এস’ টেলিভিশনে অজ্ঞাত স্থান থেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তার সঙ্গে ওপরোক্ত হাবুল-বাবুল বিষয়ক কল্পিত কাহিনির মিল আছে।
ওই সাক্ষাৎকারে হাছান মাহমুদ খুব তমিজের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামের আগে ‘জনাব’ এবং পরে ‘সাহেব’ বসিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরেরও নামের আগে-পরে এই দুটি সম্মান ও সম্ভ্রমসূচক বিশেষণ জুড়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমি বিএনপির সাথে অনেক ক্ষেত্রে একমত।...এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান সাহেব কিংবা বিএনপির মহাসচিব জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব যে বক্তব্যগুলো দিচ্ছেন, সেগুলোর অনেকগুলোর সাথে আমরা একমত।’
আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে দলটির কোনো নেতা-কর্মী কিংবা কোনো সমর্থক তারেক রহমানকে প্রকাশ্যে ‘জনাব তারেক রহমান সাহেব’ বলেছেন, এমন নজির নেই।
তবে তারেক রহমানকে ‘বিশ্বচোর’, ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ ‘রাজাকারপুত্র’ ইত্যাদি অভিধায় ‘অভিষিক্ত’ করার এত রেকর্ডপত্র ইন্টারনেটে আছে যার সব এই লেখায় উল্লেখ করা কলেবরগত কারণে সম্ভব নয়।
তবে এটুকু বলতে পারি, ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ হাছান মাহমুদ এক সভায় বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষ ২০১৩,২০১৪ ও ২০১৫ সালে দেখেছে তারেক রহমান লন্ডনে বসে দেশে বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দিয়ে নৈরাজ্য চালিয়েছিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশের মানুষের হাজার হাজার টাকা বিদেশে পাচার করেছিলেন দুর্নীতির এ বরপুত্র।’
‘আওয়ামী লীগকে সরিয়ে তারেককে বীরের বেশে বাংলাদেশে আনতে হবে’—বিএনপির মহাসচিবের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে হাছান মাহমুদ ওই বছরের ২৫ জুলাই তারেক রহমানকে ‘আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চোর’ বলে গালিগালাজ করেছিলেন।
২০২৪ সালের ৪ জুন হাছান মাহমুদ এও বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি, দুঃশাসনের বরপুত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর মির্জা ফখরুল তাদের মুখপাত্র।’
২০২৩ সালের ২৮ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘তারেক জিয়া চোর হ্যায়, গালি গালি মে শ্যোর হ্যায়’।
২০২৩ সালের ১২ নভেম্বর সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এতিমের টাকা আত্মসাৎ করে খালেদা জিয়া জেলে। আমি দয়া করে তাকে বাসায় থাকার অনুমতি দিয়েছি, আমার ক্ষমতাবলে। তার ছেলে তারেক জিয়া, রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে লন্ডন গিয়ে বসে আছে।...ওখান থেকে আগুন জ্বালাতে বলে। আরে ব্যাটা তোর যদি সাহস থাকে তাহলে বাংলাদেশে ফিরে আয়, আমরা একটু দেখি।’
আওয়ামী লীগের ওপরের সারির নেতারা তারেক রহমানকে যা হোক অপেক্ষাকৃত প্রমিত ভাষায় ‘চোর’, ‘খুনি’ ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছিলেন; শেখ হাসিনাসহ কেউ কেউ ‘তুই তোকারি’ করে সম্বোধনও করেছিলেন।
কিন্তু দলটির জেলা পর্যায়ের কোনো কোনো নেতা প্রকাশ্য জনসভায় রীতিমতো মাইকে তারেক রহমানের নামের সঙ্গে কথ্যভাষার এমনসব বিশেষণ যুক্ত করেছিলেন যা হাছান মাহমুদসহ যেকোনো শিক্ষিত লোকের কাছে অকথ্য এবং শোনা কঠিন। সেসব বিশেষণকে লোকে অতি নিম্নশ্রেণির গালিগালাজ বলে থাকে।
তারেক রহমানকে এসব অশ্রাব্য গালিগালাজ করার কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কাউকে কখনো ভর্ৎসনা করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বরং ক্ষেত্র বিশেষে এসব গালি গালিদাতার পদপদবি বাড়িয়েছে।
নিয়তির ফেরে সেই তারেক রহমান এখন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের কাছে ‘জনাব তারেক রহমান সাহেব’।
নির্বাচনের আগে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগকে সংলাপে বসার কথা বলায় সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বিএনপি খুনির দল, তাঁদের সাথে কীসের আলোচনা?’
এখন দেখা যাচ্ছে হাছান মাহমুদ বলছেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে ‘কাজ করার’ জন্য তৈরি আছে। ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ বলতে তিনি তাঁদের সময় যে ‘গণতন্ত্র’ ছিল, সম্ভবত সেটিই ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন।
যেহেতু হাছান মাহমুদ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, সেহেতু এই কথাকে আওয়ামী লীগের কথা বলে ধরে নেওয়া যায়।
হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘বিএনপি যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলছে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, সেটির সাথে আমরা একমত এবং প্রয়োজনে বিএনপির সাথে একযোগে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা কাজ করব।’
সরকার পতনের পরপর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিএনপির সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছিলেন। হাছান মাহমুদ সেই কথাটিকে আরও একটু পাকা করে দিয়েছেন।
এমনিতে হয়তো রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এই জগতে থেকে সকালে এক কথা আর বিকেলে আরেক কথা বলাকে খুব অন্যায় চোখে দেখার রেওয়াজ নেই।
সেই সূত্রে হাছান মাহমুদের ইউটার্ন নেওয়া কথাবার্তা শুনে কারও কারও মনে হতে পারে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শিগগিরই এক ঘাটে জল খেতে পারে।
তবে কিনা বিএনপি বলে ফেলেছে, ‘ফ্যাসিবাদী’র সঙ্গে তারা নেই। যদিও বিএনপি এই কথায় কতক্ষণ থাকবে তার গ্যারান্টি কেউ দিতে আসছে না।
এটি ঠিক, বিএনপির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
মির্জা ফখরুলের কথায় তাই মনে হচ্ছে। তিনি বলেছেন, নির্বাচন না দিয়ে এক এগারোর মতো ‘মাইনাস টু’র চেষ্টা করলে তা সফল হবে না।
বিএনপির এসব কথা আওয়ামী লীগের মনে আশা জাগাচ্ছে। বিএনপিকেও আওয়ামী লীগের কিছুটা কোণঠাসা মনে হচ্ছে। সম্ভবত সে কারণেই বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ ‘অনেক বিষয়ে একমত’ হচ্ছে।
হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘বিএনপির অনেক বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত।...বিশেষ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব যে বলেছেন, “রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার আমরা কারা? ”—এই যে প্রশ্ন তুলেছেন, আমি এটির সাথে একমত।
এমনকি ছাত্রলীগকে কাগজে নিষিদ্ধ করার পর সেটির বিরুদ্ধেও তারা বক্তব্য দিয়েছেন। আমি তাদের এই বক্তব্যের সাথে একমত।’
হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা, অগ্নিসংযোগ হওয়ার পর বিএনপি যে বক্তব্য, সেই বক্তব্যের সাথেও আমরা একমত।’
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ করার বিষয়ে তারেক রহমান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটার সঙ্গেও তিনি ‘ব্যক্তিগতভাবে একমত’।
অর্থাৎ হাছান মাহমুদের ‘একমত’ হওয়ার বিষয়ের একটি দুটি নয়; বহু।
পাবলিকের চোখের সামনে পরপর তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। এরপর সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউপি নির্বাচনের একটিতেও ভোট বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই হয়নি। টিআইবির ভাষ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। একের পর এক ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে। বিরোধী মতকে চরমভাবে দমন করা হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের মতো একটি অহিংস কর্মসূচিকে হুমকি দিয়ে, তাদের ওপর ছাত্রলীগ লেলিয়ে দিয়ে সহিংস করে তোলা হয়েছে। পুলিশ ও ছাত্রলীগের সহিংস প্রতিক্রিয়ার কারণে সেই আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেওয়ার পর সরকারের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করা হয়েছে।
হাছান মাহমুদ সবচেয়ে যে ‘দামি’ কথাটি বলেছেন, সেটি হলো, ‘আমাদের ভুল ছিল, আমরা তা স্বীকার করি’। তবে সেই ‘ভুল’ বলতে তিনি কোন বিষয়কে বুঝিয়েছেন, তা খুব স্পষ্ট নয়।
পাবলিকের চোখের সামনে পরপর তিনটি সংসদ নির্বাচনে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। এরপর সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউপি নির্বাচনের একটিতেও ভোট বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই হয়নি।
টিআইবির ভাষ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। একের পর এক ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে।
বিরোধী মতকে চরমভাবে দমন করা হয়েছে। গুম–খুন–বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো আছেই।
আমরা দেখলাম, কোটাবিরোধী আন্দোলনের মতো একটি অহিংস কর্মসূচিকে হুমকি দিয়ে, তাদের ওপর ছাত্রলীগ লেলিয়ে দিয়ে সহিংস করে তোলা হয়েছে। পুলিশ ও ছাত্রলীগের সহিংস প্রতিক্রিয়ার কারণে সেই আন্দোলন সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেওয়ার পর সরকারের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করা হয়েছে।
সে আন্দোলনে কমপক্ষে ১৫৮১ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কতজন তার কোনো লেখাজোখা নেই।
এসব কিছু যে আওয়ামী লীগের ‘ভুলে’ হয়েছে, তা তিনি বলতে ভুলে গেছেন।
তারপরও স্রেফ কথার কথা হিসেবে হলেও আওয়ামী লীগ ভুল করতে পারে এবং সেই ভুল দলটির একজন দায়িত্বশীল নেতা স্বীকারও করতে পারে—এই বিষয়টি নভেল করোনার চাইতেও বেশি নতুন ব্যাপার মনে হচ্ছে।
হাছান মাহমুদের মুখে নিজের নামের আগে ‘জনাব’ পরে ‘সাহেব’ শুনে মির্জা ফখরুল খুশি হবেন বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু তিনি হাছান মাহমুদের কথাকে ‘ভূতের মুখে রামনাম’ এবং ‘এ কথা শুনলে ঘোড়াও হাসবে’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
বিএনপির আরেক নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘তিনি তো (হাছান মাহমুদ) দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তার কথার জবাব দেওয়ার কিছু নেই।’
তিন মাস আগে যে দলটি প্রায় সীমাহীন ক্ষমতাধর ছিল; সেই দলের একজন নেতা এখন বলছেন, বিএনপির সঙ্গে তাঁরা কাজ করতে চান। আর সে সময়কার নিশ্চিহ্নপ্রায় দল বিএনপির নেতারা এখন সে প্রস্তাবে পাত্তা না দিয়ে বলছেন, ‘এসব কথা শুনলে ঘোড়াও হাসবে’।
অন্তত এইটুকুই যে কোনো রাজনীতিকের নিজের ভুল নিজের বিবেকের পাল্লায় মেপে দেখার হুঁশিয়ারি হিসেবে যথেষ্ট।
আহা, সময় কী বলবান! আহা, নিয়তি কী কৌতুকময়!
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com