বাংলাদেশের কোটাব্যবস্থা (চাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে) নিয়ে একটা বিতর্ক চলমান। কেউবা পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। তবে আশ্চর্যজনক হচ্ছে, বিতর্ক এমন, যেন কোটা অর্থ মেধাহীন। আবার মেধাভিত্তিক কোনো ধরনের কোটা নেই।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দু-একটা কথা বলতে চাই।
১. ১৯৯৯ সালে রাজধানীর রমনা থানায় অবস্থিত ভিকারুননিসা নূন স্কুল (সিদ্ধেশ্বরী শাখা) থেকে যত ছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছিল, তাদের মধ্যে অধিকাংশই গড় নম্বর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পেলেও তাদের কাউকে বৃত্তি দেওয়া হয়নি। কারণ, সংখ্যা সীমিত। যদি কোটা না থাকত, তবে সমস্ত বাংলাদেশের বৃত্তির সুযোগ রমনা থানার মধ্যেই থাকত হয়তো। জেলার বৃত্তির সুযোগ থাকত না বললেই চলে।
২. ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চল দাকোপ ও কয়রা উপজেলা থেকে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ নম্বরপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদেরই বৃত্তি দেওয়া হয়েছিল, এমনকি ট্যালেন্টপুলেও। কেননা, এর বেশি নম্বর কোনো শিক্ষার্থী পায়নি।
৩. সরকারের নীতি হচ্ছে কমপক্ষে শতকরা ৮০ নম্বর (সম্ভবত) পেতে হবে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তির জন্য। এখানেই আমার প্রশ্ন, ট্যালেন্টপুলের বৃত্তির যোগ্য কেউ না থাকলে সাধারণ বৃত্তির সুযোগ আছে। কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, যেহেতু কোটাভিত্তিক, সুতরাং ওই নম্বরে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি প্রদান করা সঠিক। আবার সাধারণ বৃত্তি তো আছেই।
৪. ভারতের ধনাঢ্য নারী সুধা মূর্তি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চান, মেধাতালিকার সবার ওপরে তাঁর অবস্থান। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সম্মত নয়। কেননা, ওই কলেজের সব শিক্ষার্থীই ছাত্র। তখন তিনি সব শর্ত মেনে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে যদি কোটাব্যবস্থা না থাকত, তবে কলেজে এখন হয়তো শুধুই ছাত্র পড়ত।
৫. বাংলাদেশের সংবিধান: ২৯। (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।
২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।
(৩) এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই-
ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে
রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।
ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি। পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস শুধুমাত্র সাড়ে সাত শতাংশ আবেদনকারীদের যোগ্যতা, শিক্ষা, যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্বাচন করে। ভারতীয় সংবিধান কেন্দ্রীয় সরকার এবং ভারতের রাজ্য এবং অঞ্চলগুলোকে ‘সামাজিক এবং শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে থাকা নাগরিকদের’ জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে ভর্তি, চাকরি ইত্যাদিতে নির্দিষ্ট শতাংশে সংরক্ষিত কোটা বা আসন নির্দিষ্ট করার অনুমতি দেয়।
ফলে বলতেই হয় যে, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সংবিধানের কোটাপদ্ধতির প্রচলন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য। তবে মেধার গুরুত্ব বাদ দিয়ে নয়।
৬. বিসিএস পরীক্ষার পাস নম্বর যদি কোনো প্রার্থীর না থাকে, তিনি কি কোটাভিত্তিক নিয়োগ পাবেন?
৭. প্রতিটি জেলায় সব পেশার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ বা পুলিশ, বিজিবি, সামরিক বাহিনীর যদি সব নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু মেধার গুরুত্ব দেওয়া হয়, তো অনেক জেলার প্রার্থীরা সুযোগই পাবেন না।
৮. যেকোনো দেশের চাকরিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কোটাব্যবস্থা চালু করা হয় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও সমতা তৈরি করার জন্য।
সংবিধানে এ জন্যই এই বিধান করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে দায়বদ্ধতা দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ মনে করি, যেকোনো পেশায় ১০০ শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষায় নিম্নতম পাস নম্বর ৬০ ধার্য করা হয়। ২০০ প্রার্থী সর্বনিম্ন ৬০ নম্বর পেয়ে চূড়ান্ত বাছাই করার সময়ই দেখা গেল তালিকার ওপরের দিকে ১০০ জনের সর্বনিম্ন প্রাপ্ত নম্বর ৭০।
অন্যদিকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫ জন প্রার্থীর গড় নম্বর ৬০। এখন কোটার আইনগত বাধ্যবাধকতা হচ্ছে ওই ৫ জনসহ মোট ১০০ জন নিয়োগ পাবেন। ওই ৫ জনের চেয়েও অনেকের নম্বর ৬০-এর বেশি, তবু কোটার সুযোগে ওই পাঁচজন চাকরি পাবেন।
যদি কোনো প্রার্থীর পাস নম্বর—সাধারণত শতকরা ৪০ বা ৫০—না থাকে, তিনি লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য। তাঁর ভাইভা বোর্ডে হাজির হওয়ার সুযোগ নেই। আবার ভাইভায় যদি পাস নম্বর—সাধারণত ২৫-এর মধ্যে ১৫—না থাকে, তাঁকে অকৃতকার্য উল্লেখ করে রেজাল্ট শিট তৈরি করা হয়?
কোটার বিবেচনা তখনই হয়, যখন কোনো প্রার্থীর পাস নম্বর থাকে। এর আগে বিবেচনার সুযোগ নেই। আবার কৃতকার্যের তালিকায় যদি দেখা যায়, শূন্য পদে চেয়ে অধিক প্রার্থীর নাম আছে, তখন তালিকার ওপর থেকে শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ পাবেন। এখানেই কোটাপদ্ধতি প্রয়োগ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এখানে মেধার কোনো অবমাননা করা হয়নি। বরং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক ক্ষমতা ক্ষমতার সুযোগ প্রদান করা হলো।
জহিরুল হক অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, বিসিএস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন