জীবনচক্র শেষ হয়ে যাওয়ায় কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যাওয়া আর ছালবাকল উঠে যাওয়া বাসগুলো সেই একই প্রতিযোগিতায় ছুটছে।
জীবনচক্র শেষ হয়ে যাওয়ায় কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যাওয়া আর ছালবাকল উঠে যাওয়া বাসগুলো সেই একই প্রতিযোগিতায় ছুটছে।

যাতায়াতে এত খরচ হলে মানুষ চলবে কীভাবে

বাসা আর অফিসের দূরত্বটা আড়াই কিলোমিটারের মতো। এ পথে যে দুটি বাস চলে অফিস শুরু ও ছুটির সময়টাতে, সেগুলোর দরজায় ঝুলে মানুষকে যাতায়াত করতে হয়। ভরসা রিকশা কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা অথবা ভাড়ায় চালিত কিংবা অ্যাপের মোটরসাইকেল। সিটিং সার্ভিস নামে চলা বাসের ভাড়া ২০ টাকা। অথচ ঠাসাঠাসি করে ভর্তি বাসে যাত্রীর সংখ্যা আসনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি ছাড়া কম নয়। 

বাসে চলাচলের সুযোগ না থাকায় বিকল্প হিসেবে রিকশা, মোটরসাইকেল অথবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা বেছে নিতে হয়। রিকশাভাড়া ৮০ থেকে ৯০ টাকা, সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আর মোটরসাইকেলের ভাড়া ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। আসা-যাওয়ার খরচ হিসাব করলে এই অঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ফলে গণপরিবহন-সংকটে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করতে ৬ থেকে ১০ গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হয়। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল করার একটা বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবহনব্যবস্থায় একটা কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন

ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর, আবার ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যয়বহুল শহর। হু হু করে বেড়ে চলা নিত্যপণ্যের দাম, বছর বছর ঐকিক নিয়মে বেড়ে চলা বাসাভাড়ার সঙ্গে যাতায়াতের অযৌক্তিক ব্যয় এই শহরকে বাসযোগ্যতার তলানিতে থাকা এক শহরে পরিণত করেছে। সম্প্রতি আলাপ হচ্ছিল যোগাযোগবিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, নাগরিকদের আয়ের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ যদি যাতায়াতে খরচ হয়, সেই শহরটিকে টেকসই ধরা হয়। আর ঢাকায় সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত। যাতায়াতের পেছনে এত খরচ করলে একজন মানুষ ঠিকমতো খাবেনই-বা কীভাবে আর চলবেনই-বা কীভাবে?

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের অনন্য এক অধ্যায়। স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান হলেও এই অনন্য ইতিহাস রচনা হঠাৎ করেই একদিন হয়নি। এরও পূর্বাপর রয়েছে। ২০১৮ সালে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে বাংলাদেশকে যে ঝাঁকুনি দিয়েছিল, পাঁচ বছর পর সেই প্রজন্মই জান বাজি রাখা বিদ্রোহ করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়েছে।

এই অভ্যুত্থান তাই স্বাভাবিকভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ও মৃত্যুর মিছিল বন্ধের কর্তব্যকে সামনে নিয়ে আসে। এটা সত্যি যে অন্তর্বর্তী সরকার জটিল এক বাস্তবতায় কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছে। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক স্রোতে আনার পাশাপাশি ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মেরামত করার গুরুদায়িত্ব তাদের ওপর বর্তেছে। 

তাই বলে সড়ক এখনো কেন এক দুয়োরানির গল্প হয়েই থাকবে। সেই আগের মতোই বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য। আর তাতে প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে, প্রাণ ঝরছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আড়াই মাস পরও ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া গভীর শঙ্কার।

চালকেরা যেমন ট্রাফিক পুলিশকে মানছেন না, আবার ট্রাফিক পুলিশও তঁাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছেন না। বেশির ভাগ সিগন্যালে বেশি বয়সী এক-দুজন কনস্টেবলকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেলেও কর্মকর্তাদের গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে কিংবা চায়ের দোকানে বসে গল্প করতে বেশি দেখা যায়। এর সঙ্গে চালক আর পথচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা ও নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতার কারণে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

সেই আগের মতো পরিবহন সমিতিগুলোকে চাঁদা দিয়ে সড়কে বাস নামাতে হচ্ছে। পরিবহন সমিতিগুলোর মাথাগুলোর শুধু পরিবর্তন হয়েছে, আওয়ামী লীগের জায়গায় এসেছে বিএনপি। সেই একই দৈনিক চুক্তিতে বাসগুলো চালক আর সহকারীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। জীবনচক্র শেষ হয়ে যাওয়ায় কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যাওয়া আর ছালবাকল উঠে যাওয়া বাসগুলো সেই একই প্রতিযোগিতায় ছুটছে।

সড়কে যাত্রী ধরতে গিয়ে সেই একইভাবে মানুষ হত্যা চলছে। ৯ অক্টোবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে পাস করে চাকরি শুরু করা তরুণী তাসনিম জাহান (আইরিন) রাস্তা পার হতে গিয়ে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় প্রাণ হারান। মাত্র ২৪-এ থেমে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ। পুরো ঢাকা এখনো সেই আগের মতোই বাস স্টপেজ, মানে যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা–নামানো চলছেই।

রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, ঘোড়ার গাড়ি; ছোট-বড়, হালকা-ভারী, দ্রুতগতির যানসহ ১৮ সংস্করণের যানবাহন চলতে দিয়ে, ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। গণপরিবহনব্যবস্থা না থাকায় মোটরসাইকেল গণপরিবহন হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ঢাকা সড়কের ফুটপাতও দখল করছে। রিসেট বাটন টিপে রাতারাতি এ ব্যবস্থাকে পাল্টে ফেলা যাবে না; কিন্তু পুরোনো ব্যবস্থার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নতুন শুরুর একটা যাত্রা তো করতে হবে।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কী কী করা দরকার, সেটা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার খুব একটা প্রয়োজন নেই। ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের পর বিশেষজ্ঞরা যে সুপারিশগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করাটা জরুরি। এ জন্য সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত দরকার আর সেটা বাস্তবায়নের জন্য দরকার একটা দক্ষ ও দরদি লোকদের নিয়ে একটি টিম।

অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলছিলেন, মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা গেলেই ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়া সম্ভব। ঢাকায় একই ছাতার নিচে একটা সিটি বাস সার্ভিস চালু করতে হবে, যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। তিন হাজার মালিকের বদলে এক বা একাধিক কোম্পানির অধীন বাসগুলো চলবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল করার একটা বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবহনব্যবস্থায় একটা কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যেসব মেগা প্রকল্প হয়েছে, সেই তুলনায় ছয় হাজার কোটি টাকা খুব বড় বিনিয়োগ নয়। কিন্তু মালিকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে কোম্পানির আওতায় আনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। হাদিউজ্জামান বলছিলেন, একটা সিটি বাস সার্ভিস চালু না করে যানজট কমাতে, নৈরাজ্য ও মৃত্যুর মিছিল কমাতে যে উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, সেটা কোনো কাজে আসবে না।

মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী