মেট্রোরেল যেন আরেকটি বাংলাদেশ রেলওয়ে না হয়

মেট্রোরেল
ফাইল ছবি

টেলিভিশনে আজকাল একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। রেলস্টেশনে ঘোষণা—ট্রেন আরও সাড়ে তিন ঘণ্টা দেড়িতে ছাড়বে! স্টেশনমাস্টারকে কৈফিয়ত জানিয়ে কোনো লাভ হলো না—উল্টো ঝাড়ি খাওয়া! পরে আবার ঘোষণা, ট্রেন ছাড়তে আরও সাড়ে চার ঘণ্টা দেরি। অতঃপর সহযাত্রীর পরামর্শে একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের ‘ডালভাজা’ খেয়ে ‘মুঠোয় মুঠোয়’ মূল্যহীন সময় পার! অতিরঞ্জিত মনে হলেও প্রকৃত অর্থে জনমানুষের কাছে বাংলাদেশ রেলওয়ের ভাবমূর্তি অনেকটা এমনই। তা ছাড়া সংস্থাটি নিজ থেকে বিজ্ঞাপনটি নিয়ে কোনো প্রতিবাদও জানায়নি। যার মানে হচ্ছে, এটাই আসলে বাস্তবতা। ‘নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে’ প্রবাদবাক্যটি সম্ভবত বাংলাদেশেই প্রযোজ্য। জাপানিরা এ ধরনের প্রবাদ কখনো কল্পনাও করতে পারেন না, কেননা তাঁদের ট্রেন চলে ঘড়ির কাঁটা মেপে।

শুধু রেলওয়ে কেন, বাংলাদেশের প্রায় সব কটি সরকারি সেবাদানকারী সংস্থা নিয়েই জনগণের মনে ধারণা মোটামুটি একই রকম—বিমান, বিআরটিসি, টেলিফোন, গ্যাস কিংবা পানি। এটা ঠিক যে মোটের ওপর তারা জনগণকে কিছুটা সার্ভিস যে দিচ্ছে না, তা নয়, কিন্তু আশানুরূপ নয়। অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলা। গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয়—দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার অভিযোগ হরহামেশাই।

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত, নগর যোগাযোগে নতুন দিগন্ত মেট্রোরেল নিয়েও তা–ই ভাবনা হচ্ছে। কেননা সরকার এটি নিজে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) নামের একটি সরকারি মালিকানাধীন সংস্থার মাধ্যমে। বড় স্থাপনা নিজে চালানো, তথা নিজের পায়ে দাঁড়ানো বা স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য আমাদের সরকারি সংস্থাগুলোর মানোন্নয়ন তথা প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজনীয়। তবে এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত স্থাপনা প্রথমেই সরকারি সংস্থা দ্বারা পরিচালনা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।  

এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি নির্মিত আরেকটি বড় স্থাপনা পদ্মা সেতুর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সরকার এটি পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেকটা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পদ্মা সেতুর টোল আদায়ের কাজটি যৌথভাবে পরিচালনা করছে পদ্মা সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন। তাদের পক্ষে মাঠপর্যায়ে কাজটি করছে বাংলাদেশের টেলিটেল কমিউনিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর আদায় করা টোলের টাকা জমা হচ্ছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে। মেট্রোরেলের ক্ষেত্রেও এমনটি করা যেত।

অনেকটা পিপিপি আকারের মডেল বা প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে—দক্ষ কোনো বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে কিছুদিন অন্তত চালানো যেত। অতঃপর ধীরে ধীরে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে।

রেলগাড়ি আমরা চালাতে পারি বটে। কিন্তু যা পারি না, তা হচ্ছে সময় মেনে তা চালানো বা এর পরিবেশ তথা পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার এই ক্রান্তিলগ্নে সুপরিসর ও নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আরও সুসভ্য ও দায়িত্বশীল আচরণও একান্ত কাম্য। নগরে মেট্রোরেল আধুনিকতার প্রতীক। আমরা একে আরেকটি বাংলাদেশ রেলওয়ে হিসেবে দেখতে চাই না।

আসলে মেট্রোরেল পরিচালনার কাজটি মোটেই সহজ কিছু নয়, অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল। ঢাকা মেট্রোতে ব্যবহৃত ছয় বগির সমন্বয়ে একটি ট্রেনের দাম কত? প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার। ১৫-২০ মিলিয়ন ডলার হলে আপনি একটা ছোট বিমান কিনতে পারেন। অনেকেই কলকাতার সঙ্গে ঢাকার মেট্রোরেলের তুলনা করছেন। ১৯৮৪ সালে নির্মিত কলকাতার পাতালরেলটি মূলত একটি সাধারণ রেলগাড়ি। মাটির নিচ দিয়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই নয়। গতিও অনেক কম। ১০ মিনিট পরপর এটি ছাড়ত। কিন্তু যখন আপনি তিন মিনিট পরপর ছাড়তে সক্ষম একটি মেট্রো ১০০ কিলোমিটার গতিতে চালাবেন, তখন বগি ও লাইনের কারিগরি জটিলতা আর দাম বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১০ গুণ। কেননা তখন ট্রেনটিতে অত্যাধুনিক ব্রেক আর সেন্সর সিস্টেম দিয়ে সামনের রেল থেকে দূরত্ব বজায় রাখা ও দুর্ঘটনা এড়ানোর প্রযুক্তি প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় অত্যাধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম, অটো ড্রাইভিং সুবিধা, উন্নত ট্র্যাক আর স্টেশনের। অর্থাৎ, পুরো গাড়িটিই যেন একটি চলন্ত রোবট! ঢাকা মেট্রোতে আসলে একধরনেরই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। মেঝে ব্যবহার করা হয়েছে গ্রানাইট পাথর কিংবা অন্যত্র উন্নতমানের স্টেইনলেস স্টিল। চীনা পণ্য হলে তা অনেক কমে পাওয়া যেত, কিন্তু এটা জাপানি।     

তবে চিরায়ত বাংলা প্রবাদ, ‘একটি বিশেষ প্রাণীর পেটে ঘি হজম হয় না’ বলে কিছুটা ভয় জাগছে বটে। ইতিমধ্যেই মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার লাগানো শুরু হয়ে গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে অধৈর্য যাত্রীরা কলাপসিবল গেট টপকে স্টেশনে ঢুকে গেছেন, যার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। রেলের তারে ফানুস পড়ে লাইন বিকল। আর চালুর কয়েক দিনের মধ্যেই টিকিট মেশিন নাকি কাজ করছে না! কিছুদিন আগে পত্রিকায় মেট্রোরেলসংক্রান্ত একটি নিউজের নিচে পাঠকের প্রতিক্রিয়া এখানে উল্লেখ্য। তাঁর মতে, শিগগিরই মেট্রোরেলের প্রতিটি স্টেশনে টিকিট মেশিনটি নষ্ট করে দেওয়া হবে। অতঃপর স্টেশনের কর্মচারীদের কাছ থেকে কয়েক গুণ দামে টিকিট কার্ড সংগ্রহ করতে হবে ব্ল্যাকে বা চোরাবাজার থেকে। তাহলে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী কি সত্য হতে যাচ্ছে? এটা সর্বজনবিদিত যে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকিট আজকাল সচরাচর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অনলাইন বা স্টেশন থেকে কেনা যায় না, কিনতে হয় ব্ল্যাক থেকে চড়া দামে। মেট্রোরেলেও তেমনটি শুরু হয়ে যাচ্ছে কি না?  

সর্বোপরি মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কারা আছেন? ডিএমটিসিএলের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতীয়মান যে এর পরিচালনা পর্ষদের ১১ জনের মধ্যে ১০ জনই নন-টেকনিক্যাল। ব্যবস্থাপনায় সব সময় যে বিশেষজ্ঞ  লোক থাকতে হবে, তা–ও অবশ্য ঠিক নয়। তবে আনুপাতিক হারের চিত্রটি বাস্তবসম্মত নয়। অধিকাংশ এসেছেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে। এটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। দেশের একমাত্র মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘স্পারসো’ চালাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন, যা সম্প্রতি খবরে এসেছিল আর প্রথম আলোর সম্পাদকীয় লিখেছিল এর ওপর। একই অবস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে শুরু করে আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কিছু গল্প শুনলাম এ রকম, রাডার বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য তাঁদের বিজ্ঞানী না পাঠিয়ে, পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। কানাডায় পানিসংক্রান্ত একটি সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল কনফারেন্সে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল একটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার। ভাবলাম হয়তো প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে এসেছেন, কেননা এর বাইরে কেউ সচরাচর এ ধরনের সম্মেলনে আসেন না। কিন্তু না, তিনি এসেছেন সরকারি খরচে শুধুই জ্ঞান অর্জনের জন্য! অবশ্য পরদিন আর তাঁকে খুঁজে পাইনি। আরেক সরকারি চিকিৎসক একবার আক্ষেপ করে জানাচ্ছিলেন যে মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত প্রশিক্ষণ বাজেটের সুবিধা চিকিৎসকেরা খুব কমই পান, বিদেশ ঘোরেন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। মেট্রোরেলের ক্ষেত্রেও এমনটি হলে ভবিষ্যৎ তেমন ভালো ঠেকছে না।

ঢাকা শহরে ট্রাফিক জ্যামের আর্থিক ক্ষতি ধারণা করা হয় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বছরে। আর এই যানজট নিরসনে নানা পরিকল্পনার একটি অংশ এই মেট্রোরেল। ফলে পদ্মা সেতুর প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ব্যয়ে এই মেট্রোরেলটি নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কারিগরি চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় এটি পদ্মা সেতুর চেয়েও জটিলতর। উচ্চ দামের বগি থেকে আরম্ভ করে জটিল সিগন্যালিং—সবকিছুই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিকতম। ফলে বাংলাদেশের জন্য এই ব্যবস্থার কারিগরি জটিলতা আয়ত্তে নেওয়া ও তা দক্ষতার সঙ্গে চালানো সামনের দিনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই প্রয়োজনীয় একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এ ক্ষেত্রে দ্রুত প্রয়োজনীয়। একের পর এক বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করছে বাংলাদেশ। এর অধিকাংশই বিদেশি প্রতিষ্ঠান দ্বারা নির্মিত। দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে, আমাদের প্রকৌশলীদের এসব বিষয়ে আরও বেশি সম্পৃক্তকরণ ও ধীর ধীরে প্রযুক্তি হস্তান্তর নীতির মাধ্যমে একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার সুযোগ ছিল এখানে।

একই সঙ্গে প্রয়োজন দক্ষ ব্যবস্থাপনা, জনগণের সচেতন তথা সভ্য আচরণ। রেলগাড়ি আমরা চালাতে পারি বটে। কিন্তু যা পারি না, তা হচ্ছে সময় মেনে তা চালানো বা এর পরিবেশ তথা পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার এই ক্রান্তিলগ্নে সুপরিসর ও নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আরও সুসভ্য ও দায়িত্বশীল আচরণও একান্ত কাম্য। নগরে মেট্রোরেল আধুনিকতার প্রতীক। আমরা একে আরেকটি বাংলাদেশ রেলওয়ে হিসেবে দেখতে চাই না।

  • ড. মো. সিরাজুল ইসলাম অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেস (সিআইআরএস), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।