সংঘাতের শুরু, এরপর কী

২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘাতের সূত্রপাত নিয়ে সংবাদপত্রগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য পাওয়া যায়। ঠিক কীভাবে এর সূত্রপাত হয়েছিল, তা নিশ্চিত করা কঠিন। প্রথম আলো বলছে, সমাবেশ শুরুর আগেই কাকরাইলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষ পরে বিজয়নগর পানির ট্যাংক থেকে শান্তিনগরে ছড়ায়।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কাকরাইল মসজিদের সামনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বহনকারী একটি বাস ও দুটি পিকআপে হামলা হয়। হামলাকারীরা বাসটি ভাঙচুর করে। বাস থেকে নেমে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা দৌড়ে স্থান ছাড়েন। এ সময় তাঁদের লাঠি হাতে ধাওয়া দেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

দৈনিক বাংলা মোড়ে দায়িত্বরত অবস্থায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে আমিনুল পারভেজ নামের একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। বেলা তিনটার দিকে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে এই হাসপাতালের সামনেই শামীম মিয়া নামের একজনের মৃত্যু ঘটে। যুবদল তাঁকে তাদের কর্মী হিসেবে দাবি করেছে। দুপুরের পর থেকে বাস ও অন্যান্য স্থাপনায় ভাঙচুর ও আগুনের খবর আসতে থাকে।

বছরখানেক ধরে বিএনপি তাদের সমাবেশকে একটা ভিন্ন চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা সারা দেশে তারুণ্যের সমাবেশের মতো অভিনব কর্মসূচি দিয়েছে। তবে গতকালের এই সংঘাত তাদের আবার পিছিয়ে দিল, এ কথা বলাই যায়। বিএনপি নেতা–কর্মীদের গতকাল হতোদ্যম মনে হয়েছে

বিএনপির মহাসমাবেশ ও আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশের তারিখটি ২৮ অক্টোবর ছিল এবং জনমনে শঙ্কা ছিল। তবু অনেকেই ধারণা করেছিলেন এবারকার ২৮ অক্টোবর সংঘাতমুক্ত হবে। তা ছাড়া বিএনপির সাম্প্রতিক সমাবেশগুলো দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শনিবারের জনসভা নিয়ে নানা অনিশ্চয়তার পর শেষ মুহূর্তে এবং শর্ত সাপেক্ষে হলেও বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই সমাবেশের জায়গা পায়। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে নানাভাবে হুমকি দিলেও বিএনপিকে যথেষ্ট সংযত মনে হয়েছিল। পথে পথে বাধা, কর্মী গ্রেপ্তারের পরও সমাবেশের দু-চার দিন আগেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মীরা ঢাকায় এসে পৌঁছান। এমনকি গতকাল সকালে ট্রেনের মাথায় চড়ে ঢাকা আসার ছবি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন সংবাদ পোর্টালে।

বিএনপির সমাবেশের নির্ধারিত সময়ের আগে থেকেই ব্যাপক জনসমাগম লক্ষ করা গেছে। সংঘাত ও সহিংসতার কারণে সেই সমাবেশ কার্যত পণ্ড হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সংঘাত–সহিংসতা কেন ঘটল? বিএনপি কি প্রস্তুতি নিয়ে সংঘাত-সহিংসতা করেছে? নাকি কর্মী-সমর্থকদের তারা সামলাতে পারেনি? অথবা এর পেছনে কি কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কাজ করেছে, যার ফাঁদে পা দিয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা? এসব প্রশ্নের উত্তর যা–ই হোক, সামগ্রিক বিচারে বিএনপির কর্মসূচির এই পরিণতির দায় দলটির নেতৃত্বের পক্ষে এড়ানো কঠিন।

কাকরাইলে পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতা-কর্মীরা আশপাশের বেশ কটি ভবনে আশ্রয় নেন। তাঁদের মধ্যে দিনাজপুর থেকে আসা বিএনপির একদল নেতা-কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বাড়িতে বলে এসেছেন, যা হওয়ার এবারই হবে। দলের নেতারা একটা ফয়সালা দেবেন।

অন্যদিকে ঢাকা ও বরিশাল থেকে আসা বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলেন, তাঁরা শুধু সমাবেশে যোগ দিতেই এসেছিলেন। তাঁদের প্রতি সংঘাতে না জড়ানোর নির্দেশ ছিল। এমনকি বিকেল পর্যন্ত অনেকে ঠিক কী কারণে পুলিশ এত টিয়ার শেল ছুড়ছে বা সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ছে, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। আবদুল্লাহ আল মামুন নামের বিএনপির একজন কর্মী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হুমকির কথা মনে করান। শাপলা চত্বরের মতো করে বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হবে, এমন উক্তি করেছিলেন তিনি। তাঁদের ধারণা ছিল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হচ্ছে সমাবেশস্থলে যেন তাঁরা যেতে না পারেন, সে জন্য।

বোঝা যায়, এই বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী সমাবেশকে কেন্দ্র করে কী করবেন, কতটা করবেন, সে সম্পর্কে দলের পক্ষ থেকে সম্ভবত কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা বা ধারণা দেওয়া হয়নি। নয়াপল্টনের আশপাশে পুলিশের সঙ্গে গতকালের সংঘর্ষের পর আজ রোববার তারা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। বিএনপির মিডিয়া সেল তাদের এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছে, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপির শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে হরতাল।’ হরতাল ডাকার পরপরই বাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

গতকাল ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য বলেছেন, তাঁরাও ধারণা করেননি যে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে এ ধরনের সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাঁদের প্রস্তুতি ছিল, কিন্তু সেটা যে এদিকে গড়াবে, তাঁরা বুঝতে পারেননি।

তবে প্রশ্ন উঠছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। দুপুরের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপের বিপরীতে টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার পর বেশ কিছু যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর আসে। কাকরাইলে অসংখ্য পুলিশ ও বিজিবি সদস্যের উপস্থিতিতে কীভাবে বাসে, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আগুন ধরছে, তা নিয়ে ধন্দে আছেন কেউ কেউ। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল কেন অরক্ষিত ছিল, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

বছরখানেক ধরে বিএনপি তাদের সমাবেশকে একটা ভিন্ন চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা সারা দেশে তারুণ্যের সমাবেশের মতো অভিনব কর্মসূচি দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, গতকালের এই সংঘাত-সহিংসতা কি বিএনপির ধারাবাহিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অর্জনকে নষ্ট করে দিল? নাকি এমনই হওয়ার কথা ছিল? এরপর কী?

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    sabiha.alam@prothomalo.com