বিদ্রোহীদের আক্রমণে এ পর্যন্ত কমপক্ষে চারটি সামরিক ঘাঁটি, ৩০০টি সেনাচৌকি এবং বেশ কয়েকটি বড় শহরের পতন হয়েছে।
বিদ্রোহীদের আক্রমণে এ পর্যন্ত কমপক্ষে চারটি সামরিক ঘাঁটি, ৩০০টি সেনাচৌকি এবং বেশ কয়েকটি বড় শহরের পতন হয়েছে।

মতামত

মিয়ানমারের জান্তা সরকার কি পতনের মুখে?

অক্টোবর মাসের শেষ দিকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জাতিগত তিনটি সশস্ত্র সংগঠন (এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন বা ইএও) দেশটির উত্তরাঞ্চলে বড় সামরিক অভিযান পরিচালনা করে সফলতা পেয়েছে। এ সাফল্যের পরপরই অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন ও মিলিশিয়া গোষ্ঠী [এদের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর গঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফএস)] রয়েছে মিয়ানমারের পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চলে জোরদার লড়াই শুরু করেছে, যা দেশটির জান্তা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে।

অনেককে বিস্মিত করে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী (তাতমাদো) একের পর এক বড় পরাজয়ের মুখে পড়েছে। অসমর্থিত সূত্রের খবর অনুযায়ী বিদ্রোহীদের আক্রমণে এ পর্যন্ত কমপক্ষে চারটি সামরিক ঘাঁটি, ৩০০টি সেনাচৌকি এবং বেশ কয়েকটি বড় শহরের পতন হয়েছে।

চীন ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও যোগাযোগের মূল পথটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ভারী অস্ত্রসহ বিশাল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিদ্রোহীরা নিজেদের অধিকারে নিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হর্সি বলেছেন, এই বিজয়গুলো হলো ‘২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর সামরিক বাহিনীর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ’। সম্ভবত ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর মিয়ানমারের কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে বড় আঘাত। এর ফলে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে বড় কৌশলগত এবং ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটেছে।

এসব ঘটনা অবধারিতভাবে সংবাদমাধ্যমের খবর ও বিশ্লেষণে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিদ্রোহীদের সফলতা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মিয়ানমার ‘বাঁকবদলের চূড়ান্ত সীমায়’ পৌঁছে গেছে। জ্ঞানী–গুণী, সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মীরা দাবি করছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার ‘মারাত্মকভাবে জখম’,  ‘মরণফাঁদে আটকে গেছে’ এবং এমনকি ‘ভেঙে পড়ার একেবারে প্রান্তে’ পৌঁছে গেছে।

কিছু কিছু বিবৃতিতে এই দাবিও করা হচ্ছে, জান্তা সরকার দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছে। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটছে, সেই প্রস্তুতি সরকার যেন নেয়। তাদের একজন বিশ্লেষকের ভবিষ্যদ্বাণী হলো, দেশজুড়ে যে ঝড় বইছে, তাতে ভেঙে পড়বে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

নেপিদোতে সম্প্রতি জান্তা সরকারের মন্ত্রিসভা ও সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে রদবদল এবং কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত জেনারেলের গ্রেপ্তারের ঘটনা উল্লেখ করে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার ‘মরিয়া’ হয়ে উঠেছে এবং ভেতরে-ভেতরে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট সতর্ক দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ধসে পড়ার জন্য প্রস্তুত থাকা’।

অনেকে আবার এককদম এগিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘যুদ্ধোত্তর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ কী হবে, সেই পরিকল্পনা করার সময় এসেছে।’ একজন শিক্ষাবিদ তো জাতিসংঘের হস্তক্ষেপই কামনা করেছেন।

এটা সত্যি যে পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসসহ মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো উল্লেখ করার মতো সাফল্য পেয়েছে। এখন পর্যন্ত সংগঠনগুলোর মধ্যে বিস্তর রাজনৈতিক পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু সামরিক ক্ষেত্রে তারা অভূতপূর্ব সহযোগিতার নিদর্শন দেখাতে পেরেছে। এর ফলে তারা মিয়ানমারের তিন ভাগের দুই ভাগ অঞ্চলে যৌথভাবে এবং সম্মিলিতভাবে অভিযান পরিচালনা করতে পারছে। তারা নাটকীয় ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে।

মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এত উচ্চমাত্রার সহযোগিতার সম্পর্ক সামরিক জান্তার সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্নের কারণ। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর এত জনবল নেই যে একই সময়ে দেশের কয়েকটি জায়গায় তারা অভিযান পরিচালনা করতে পারবে। আবার ভ্রাম্যমাণ স্ট্রাইকিং ফোর্সকে সময় ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠাতে না পারার ব্যর্থতা যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দুর্বল জায়গা, সেটাও উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।

সার্বিক বিবেচনায়, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার খুব দ্রুত ধসে পড়বে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করা ঠিক হবে না। কেননা খুব সীমিত তথ্য আর অসমর্থিত সূত্রের ওপর ভিত্তি করে এ ধারণা করা হচ্ছে। এর কিছুটা দূরবর্তী কল্পনা এবং কিছুটা শুভবুদ্ধিজাত। সন্দেহ নেই যে সামরিক জান্তা গভীরভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, কিন্তু তারা ভেঙে পড়বে, সেটা বলাটা আগাম হয়ে যাবে। সাম্প্রতিক অভিযানে সামরিক সরকার অনেক বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে, কিন্তু এতে করে তাদের অস্তিত্বের হুমকি তৈরি হয়নি।

অ্যান্টনি ডেভিস এশিয়া টাইমস–এ লিখেছেন, জান্তা সরকারের জন্য ভালো কোনো বিকল্প নেই। যাহোক এর অর্থ এই নয় যে সাম্প্রতিক পরাজয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানো ও সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। অতীতে মিয়ানমারের জেনারেলরা বিস্ময়কর বাস্তববাদিতা এবং সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও টিকে থাকার সক্ষমতা দেখিয়েছেন। তাদের সেই অন্তর্নিহিত শক্তিকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

সব সমস্যার পরও তাতমাদো এখনো শক্তিশালী। তারা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং সুপ্রশিক্ষিত। ফেডারেল ইউনিয়ন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে একত্র হওয়া বিরোধী দলগুলোর সামনে বড় বাধা তৈরি করার যথেষ্ট ক্ষমতা তাদের রয়েছে। সাম্প্রতিককালে যেসব ঘাঁটি বিদ্রোহীদের হাতে গেছে, সেগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট। তাতমাদোর কোনো ইউনিট এত সহজে পরাজিত করা সম্ভব হবে না।

সশস্ত্র বাহিনীকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা এখনো যৌক্তিকভাবে অনুগত ও সংহত অবস্থায় রয়েছে। বাহিনীর ভেতরে অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা ও আরও বিষয় রয়েছে। কিন্তু শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মতো কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নেই। যুদ্ধরত কোনো একটি প্রধান ইউনিটের মধ্যে এমন কোনো বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েনি কিংবা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে এমন কোনো অসংগত মতপার্থক্য তৈরি হয়নি, যাতে জান্তা সরকারের পতন ঘটতে পারে।

  • অ্যান্ড্রু সেলথ গ্রিফিথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত