কেউ পছন্দ করুক আর না–ই করুক, বাস্তবতা হচ্ছে ইমরান খান এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা
কেউ পছন্দ করুক আর না–ই করুক, বাস্তবতা হচ্ছে ইমরান খান এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা

ইমরান খান এবার এলবিডব্লিউ নাকি নটআউট?

রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির তথ্য গোপন করায় ইমরান খানকে আইনসভা নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)। এর মধ্য দিয়ে তিনি কি রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লেন? অবশ্যই না। ইসিপির এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন ইমরান। তাঁর সেই আবেদন টিকতেও পারে, আবার খারিজও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইসিপির এই সিদ্ধান্ত গুরুতর সামাজিক অসন্তোষের জন্ম দেবে।

কেউ পছন্দ করুক আর না–ই করুক, বাস্তবতা হচ্ছে ইমরান খান এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা (সম্ভবত সর্বকালের)। আগামী আইনসভা নির্বাচন যে সময়ে হওয়ার কথা সেই সময়ে অথবা তার আগে যেকোনো সময়ে অনুষ্ঠিত হয় আর ইমরান খান তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পান তাহলে তার দলে যে জিতবে, সেটা প্রায় নিশ্চিত। আর নির্বাচন যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায় (যার সম্ভাবনা এখন তৈরি হয়েছে) তাহলে পাকিস্তান আবার অনিশ্চয়তার ফুটন্ত কড়াইয়ের মাঝে পড়ে যাবে।

উপরন্তু ইমরান খানকে ছাড়া পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দলটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। সে ক্ষেত্রে ছদ্মভাবে টিকে থাকা গণতন্ত্রটাও বিপন্ন হবে। তাতে আন্তর্জাতিক পরিসরে একঘরে রাষ্ট্র হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে পাকিস্তান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান সফল হয়েছিলেন, সেটা বলা যাবে না। রক্ষক হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি ভীষণভাবে কলঙ্কিত হয়েছিল। তিক্ত হতাশার অভিজ্ঞতা থেকে পাকিস্তানের বেশির ভাগ রাজনৈতিক মনীষা তার সঙ্গে ছেড়েছিল।

তথাপিও দেশের তরুণ সম্প্রদায় কখনোই ইমরান খানকে ছেড়ে আসেনি। কেননা তারা দেখেছে অন্য রাজনীতিকেরা কতটা অসংশোধনীয় দুর্নীতির মধ্যে নিজেদের নিমগ্ন করেছেন। আর সে কারণে তরুণদের জীবন কীভাবে বিপদাপন্ন হয়েছে। ইমরান খান যে একজন ফেরেশতা নন, তা নিয়ে তরুণেরা যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের সঙ্গে তুলনা করে তরুণেরা এবং দরিদ্র্য শ্রেণির গরিষ্ঠ অংশ ইমরানকে এখন ফেরেশতা হিসেবেই বিবেচনা করছেন। এ বাস্তবতায় জাতীয় রাজনীতি যদি নির্ধারিত সময়ে হয় তাহলে ইমরান খান কি সেই নির্বাচনে তার দলকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন?

এড়ানো সম্ভব নয় এমন অনেকগুলো বাস্তবতা রয়েছে, যার কারণে পাকিস্তানে শিগগিরই কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র এবং নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, বিচার, আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তা সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের চিন্তার ধরনের কারণেই সেটা সম্ভব নয়। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মৌলিক পরিবর্তন অত্যাবশ্যকীয়।

অনেকে এখন এই প্রশ্নও করছেন, ইমরান খান কি নিজেকে পরিবর্তন করে দ্বিতীয় ইনিংসে আরও সফল প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন? তিনি কি তাঁর দলকে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারবেন? প্রথম ইনিংসে তাঁর পাশে যেসব অনুগত ঘিরে ছিলেন তাঁদের বদলে কি নতুনদের তিনি আনতে পারবেন? জঘন্য দুর্নীতি নির্মূল করতে সিঙ্গাপুর মডেল গ্রহণ করতে পারবেন? তিনি কি সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন? ধর্মীয় চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে কি উপড়ে ফেলতে পারবেন, নাকি আগের মতোই আপস করবেন? তিনি কি আইএমএফের ‘ধনীদের জন্য সমাজতন্ত্র বাকিদের জন্য মুক্ত বাজার’ নীতি দেখেও না দেখার ভান করবেন অথবা টেকনোক্র্যাটদের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন? চীনের কৌশলগত আস্থা কি তিনি আবার পুনরুদ্ধার করতে পারবেন? পাকিস্তানের প্রতি আফগানিস্তানের আস্থা কি তিনি আবার অর্জন করতে পারবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর ভোটের ফলাফলের ওপরই কেবল নির্ভর করে।

আগামী দিনে যেকোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কোন বিশ্বের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন? বৈশ্বিক উষ্ণতা সারা বিশ্বকে একটা সম্মিলিত অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব বিশ্বকে বলেছেন, জলবায়ু সংকট আজকের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংকট। প্রত্যেকটা দেশের সরকারকে এখন জলবায়ু ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জলবায়ু বিপর্যয়ের একটা সন্ধিক্ষণে আমরা। আজকের সবচেয়ে উষ্ণ গ্রীষ্মও আগামীকাল সবচেয়ে শীতল গ্রীষ্মে রূপান্তরিত হতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশগুলো এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। এবারের বর্ষায় পাকিস্তানের তিন ভাগের এক ভাগ এলাকা ডুবে যায়। ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই এই দায় শোধ করতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো সহযোগিতা, সংলাপ ও সমস্যা সমাধানের সামষ্টিক কোনো উদ্যোগ নেই। বিশ্বে আমাদের একটা জোট গড়া প্রয়োজন।

ইমরান খান যে একজন ফেরেশতা নন, তা নিয়ে তরুণেরা যথেষ্ট সচেতন

আগামী নির্বাচনে ইমরান খান কিংবা অন্য কেউ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন জলবায়ু সংকট তাঁকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নেতা হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি সেভাবেই তৈরি ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো কিছুই সহজভাবে অর্জন করা যাবে না। ভারত তার একগুঁয়ে অবস্থান বজায় রাখতে পারে। ঘরে ও বাইরে বিরামহীন বিরোধিতা আসতে পারে। বিদ্যমান সংস্থাগুলো কোনো সহযোগিতা না–ও করতে পারে। কিন্তু ব্যর্থতা কোনো বিকল্প হতে পারবে না।

এড়ানো সম্ভব নয় এমন অনেকগুলো বাস্তবতা রয়েছে, যার কারণে পাকিস্তানে শিগগিরই কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র এবং নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, বিচার, আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তা সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের চিন্তার ধরনের কারণেই সেটা সম্ভব নয়। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মৌলিক পরিবর্তন অত্যাবশ্যকীয়।

আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও বন্যার কারণে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকেও কম। মাথাপিছু আয়বৈষম্যের কারণে প্রতিবছর জলপ্রপাতের মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যাচ্ছে। ২০৫০ সালে পাকিস্তানের জনসংখ্যা হবে ৩৫ কোটি। বোঝায় যাচ্ছে, পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে আজকের জলপ্রপাত মৃতপ্রায় মানুষের সমুদ্রে পরিণত হবে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন পাকিস্তানে জনগণ সম্মান করে এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন। সেই নেতৃত্ব কেবল জনগণের বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে।

আশরাফ জাহাঙ্গীর কাজী যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং ইরাক ও সুদানে জাতিসংঘ মিশনের প্রধান

দ্য ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ